রবির দুর্নীতির নথি দুদকে
মোবাইল ফোন অপারেটর রবি আজিয়াটা লিমিটেডের বিভিন্ন দুর্নীতির নথিপত্র সংগ্রহ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (বিটিআরসি) এবং রবি— এ তিন সংস্থা থেকে এ সব নথিপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। দুদক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘চলতি সপ্তাহে এনবিআর, বিটিআরসি ও রবি থেকে তলবকৃত বিভিন্ন নথিপত্র হাতে পাওয়া গেছে। নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিটিআরসির নথিতে পর্যাবেক্ষণমূলক বেশকিছু মতামত উল্লেখ করা হয়েছে।
রবি কর্তৃপক্ষ জানায়, বিষয়টি নিয়ে আদালতে চারটি মামলা রয়েছে। তাই ওই মামলাগুলোর কাগজপত্রসহ আরও কিছু নথি তলব করা হয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, গত আগস্ট মাসে মোবাইল ফোন অপারেটর রবি আজিয়াটা লিমিটেডের বিরুদ্ধে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, কর ফাঁকি, অর্থপাচার ও তরঙ্গ ফির এক হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। কমিশনের এক সহকারী পরিচালক এ অভিযোগ অনুসন্ধান করেন।
সূত্র আরও জানায়, রবি আজিয়াটা লিমিটেড আরও চারটি কোম্পানি খুলে সরকারকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে বড় কোম্পানিটি হলো ‘ই-ডটকো’।
এর মালিকানা রবির মূল কোম্পানি মালয়েশিয়ার আজিয়াটা গ্রুপের শীর্ষ ব্যক্তিরা। বর্তমানে রবি এই খাত থেকে সবচেয়ে বেশি আয় করলেও সেই টাকা মূল কোম্পানির অ্যাকাউন্টে জমা না করে প্রতি মাসে শত কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে।
যদিও রবি বরাবরই বলার চেষ্টা করছে ‘ই-ডটকো’ একটি বাংলাদেশী কোম্পানি। রবি তাদের মাধ্যমে আউটসোর্সিং করে নেটওয়ার্ক ডিভিশন চালাচ্ছে।
এনবিআর সূত্র মতে, ‘ই-ডটকোর’ আয় করা টাকা অবৈধভাবে বিদেশ পাচার হয়ে যাচ্ছে। কারণ ‘ই-ডটকোর’ বেশিরভাগ শেয়ারহোল্ডারই বিদেশী।
দুদক সূত্র আরও জানায়, তরঙ্গ চার্জের নামে এক হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করছে রবি আজিয়াটা। ১৫ বছর আগে একটেল নামে ব্যবসা শুরু করে আজিয়াটা গ্রুপ। শুরুতে তারা ১৭ দশমিক ৮ মেগাহার্টজ ফ্রিকোয়েন্সি (তরঙ্গ) নিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও কোনো তরঙ্গ চার্জ দেয়নি। ওই সময় নানাভাবে তৎকালীন একটেলের কাছে ফ্রিকোয়েন্সি ফি চাওয়া হলেও নীতিমালা না থাকার অজুহাতে এই তরঙ্গ চার্জ দেয়নি তারা। আর এভাবে ১১ বছর একটেল সর্বনিম্ন এক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।
পরবর্তী সময়ে বিটিআরসি কিছুটা কঠোর অবস্থান নিলে ২০০৮ সালে মাত্র ৫ মেগাহার্টজ ফ্রিকোয়েন্সি কেনে আজিয়াটা। যা থেকে সরকার এখন দুই হাজার ১৬০ কোটি টাকা আয় করছে। অথচ ওই সময় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপালসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ এ তরঙ্গ বিক্রি করে মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল। ভারত ওই সময় প্রতি মেগাহার্টজ ফ্রিকোয়েন্সি বিক্রি করে আয় করেছিল ১১ কোটি ৩০ লাখ রুপি। আর বিটিআরসির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে রবি সরকারকে এ বিরাট অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করেছে।
সূত্র জানায়, সিম রিপ্লেসমেন্টের নামে ৬৫৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে রবি। ২০০৭ সালের মার্চ থেকে ২০১১-এর জুন পর্যন্ত সময়ে ৫২ লাখ ৬১ হাজার ৫৪১টি সিম রিপ্লেসমেন্টের নামে নতুন গ্রাহকের কাছে সিম বিক্রি করে এ অর্থ ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। এনবিআর বিশেষ অনুসন্ধান চালিয়ে প্রাথমিকভাবে এ দুর্নীতি খোঁজ পায়।
দশম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে সংসদ সদস্য এ কে এম মাইদুল ইসলামের এক প্রশ্নের জবাবে তৎকালীন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী (সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত) সংসদকে জানিয়েছিলেন, ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত রবি আজিয়াটা লিমিটেডের কাছে সরকারের পাওনা ২১৯ দশমিক ১০ কোটি টাকা। অথচ এই সময়ের মধ্যে অপারেটরটি বিদেশে পাঠিয়েছে ১২ দশমিক ২৯ কোটি টাকা। তিনি আরও জানিয়েছেন, এই সময়ে একমাত্র টেলিটক ছাড়া অন্য পাঁচটি মোবাইল অপারেটর দুই হাজার ৫৪৭ দশমিক ১৪ কোটি টাকা বিদেশে পাঠিয়েছে।
২০১০ সালের ২৮ মার্চ ‘রবি’ ব্র্যান্ড হিসেবে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে রবি আজিয়াটা লিমিটেড। মালয়েশিয়াভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি আজিয়াটা গ্রুপ বারহাদ (আজিয়াটা) রবির ৭০ শতাংশ শেয়ারের মালিক। বাকি ৩০ শতাংশের মালিক ছিল জাপানের ডোকোমো। সম্প্রতি আজিয়াটা ডোকোমোর কাছ থেকেও ২২ শতাংশ শেয়ার কিনে নিয়েছে। বর্তমানে রবির পুরো মালিকানা মালয়েশিয়ার আজিয়াটার হাতে। এর আগে ১৯৯৭ সালে টেলিকম মালয়েশিয়া (টিএম) ইন্টারন্যাশনাল ও বাংলাদেশের এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে ‘একটেল’ নামে কোম্পানির যাত্রা শুরু করে।