শিক্ষার মান কমছে অদক্ষ থাকছে শিক্ষার্থীরা
প্রাক-প্রাথমিক থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত দেশের শিক্ষার্থীর কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না বলে সরকারিসহ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। শুধু তাই নয়, দেশের উচ্চশিক্ষার মান নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে একাধিক প্রতিবেদনে।
সরকারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ষষ্ঠ শ্রেণীর মাত্র ১৩ শতাংশের গণিতে ও ৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর ইংরেজিতে কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা আছে। অষ্টম শ্রেণীর ইংরেজিতে ৬৬ শতাংশ ও গণিতে ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর প্রয়োজনীয় দক্ষতা নেই।
অন্যদিকে, প্রথম শ্রেণীর ৩২ শতাংশ শিশু ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ১৬ শতাংশ শিশু বাংলায় একটি শব্দও বুঝে উচ্চারণ করে পড়তে পারে না বলে উঠে এসেছে একটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণায়।
এশিয়া ও আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে সাক্ষরতা ও জেন্ডার সমতা উন্নয়নে কাজ করে আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠন রুম টু রিড। এ বছরের জুন মাসে বাংলাদেশের শিশু শিক্ষার্থীদের বাংলা পঠন দক্ষতা নিয়ে প্রকাশিত ওই সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশে প্রথম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা মিনিটে মাত্র ১৬টি শব্দ ও দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা মিনিটে মাত্র ৩২টি অর্থ বুঝে উচ্চারণ করে পড়তে সক্ষম। তবে শিক্ষার প্রথম ধাপে অর্থ বুঝে মিনিটে ৪৫ থেকে ৬০টি শব্দ মাতৃভাষা উচ্চারণ করে পড়তে পারা প্রয়োজন বলে জানায় সংস্থাটি।
দেশে পাঁচ বছর বয়সী ১৫ লাখ শিশু এখনো প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার বাইরে রয়ে গেছে বলে বাংলাদেশের বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের বার্ষিক গবেষণা প্রতিবেদন ‘এডুকেশন ওয়াচ ২০১৩’ তে বলা হয়৷ এতে আরও বলা হয়, বাকি যে শিশুরা প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা নিচ্ছে, তারাও শ্রেণীকক্ষ, শিক্ষক, শিক্ষার উপকরণ, শিক্ষার পরিবেশসহ গবেষণার সব মানদণ্ডেই মানসম্পন্ন শিক্ষা পাচ্ছে না৷ এ বছরের মে মাসে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের শিক্ষাবিষয়ক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনও শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত মান অর্জন করতে পারছে না উল্লেখ করে বলা হয়, বাংলাদেশের পঞ্চম শ্রেণীর মাত্র ২৫ শতাংশ শিশু বাংলায় এবং ৩৩ শতাংশ শিশু গণিতে প্রত্যাশিত দক্ষতা অর্জন করতে পারছে। এ দুই বিষয়ে যথাক্রমে ৭৫ ও ৬৭ শতাংশ শিশু ভালোভাবে শিখছে না।
এ বছরের মার্চ মাসে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না থাকায় তারা বাঁধাধরা পদ্ধতিতে মুখস্থ পড়ান। পড়ানোর বিষয়ে শিক্ষকদের জ্ঞানের অপ্রতুলতা শিক্ষার্থীদের শেখার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
সর্বশেষ এ বছরের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত সরকারের এক প্রতিবেদনেও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান নিয়ে দুর্বলতার চিত্র উঠে এসেছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মনিটরিং এ্যান্ড ইভালুয়েশন উইংয়ের ওই মূল্যায়ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীর মধ্যে বাংলায় ৮৯ শতাংশের, ইংরেজিতে ৯২ শতাংশের ও গণিতে ৮২ শতাংশ শিক্ষার্থীর কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা নেই। অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীর মধ্যে বাংলায় ৫১ শতাংশের, ইংরেজিতে ৬৬ শতাংশের ও গণিতে ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি।
এ সব প্রতিবেদনের বাইরে এ বছরের জুলাই মাসে প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাংশের ত্রিমুখী আঁতাতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা লাভজনক পণ্যে পরিণত হয়েছে। এক থেকে তিন কোটি টাকা অবৈধ লেনদেনের বিনিময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি পাওয়া যায়। ৫০ হাজার থেকে তিন লাখ টাকা দিয়ে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদ পাওয়া যায়। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেওয়া এবং নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য উপহার ছাড়াও নগদ অর্থের লেনদেন হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেশের উচ্চশিক্ষার মানের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশে মানসম্মত উচ্চশিক্ষা বিশেষ করে গবেষণা কার্যক্রমে একেবারে পিছিয়ে আছে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি প্রক্রিয়ায় ত্রুটি, অসুস্থ রাজনীতি, নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতিসহ বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ড নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জন না হওয়া প্রসঙ্গে অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘শিক্ষার মানের নিম্নগতি ঘটেছে। টাকার বিনিময়ে অদক্ষ শিক্ষক নিয়োগ শিক্ষার মান কমার অন্যতম কারণ। এ সব অদক্ষ শিক্ষক ঠিকমতো পাঠদান করতে পারে না। ফলে শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। মাউশিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদনে এ সব তথ্যই ওঠে এসেছে। শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।’
বিভিন্ন গবেষণার ফলাফলকে আপেক্ষিক বিষয় উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘বিভিন্ন গবেষণার সূচকে শিক্ষার মান নেতিবাচক বলা হলেও সামগ্রিকভাবে দেশে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছে। তবে শিক্ষার মানের চেয়ে সংখ্যার দিকে বেশি ঝোঁক দেখাতে গিয়ে সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।’
শিক্ষার মান কমে যাওয়া প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘দেশে শিক্ষার মান কোনোভাবেই কমেনি। শিক্ষার মান অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আমাদের শিক্ষার্থীদের বিশ্বমানের শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। সেই কাঙ্ক্ষিত মান আমরা এখনো অর্জন করতে পারিনি।’