১০ বছর পূর্তি প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ দুদক
দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে স্বাধীন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ১০ বছর পার করলেও পূরণ করতে পারেনি সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা।
দুর্নীতি জাতীয় অগ্রগতির অন্যতম অন্তরায়। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বিকাশকে দুর্নীতি বাধাগ্রস্ত করছে।
একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এক জরিপে পাঁচবার শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয় বাংলাদেশ। দেশের সাধারণ মানুষ, উন্নয়ন সহযোগী, সুশীল সমাজ, রাজনীতিবিদ, গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্টদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর ‘বাংলাদেশ ব্যুরো অব এন্টি করাপশন’ বিলুপ্ত করে ‘দুর্নীতি দমন কমিশন’ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্যের চাপ ও কমিশনের অদক্ষতার কারণেই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি দুদক। দুদকের ওপর সরকার ও প্রশাসনের চাপ সৃষ্টির অপপ্রয়াস চলমান। পাশাপাশি কমিশনের কর্মকর্তাদের অদক্ষতা ও অসাধুতার নানা অভিযোগও রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক দুদক কর্মকর্তা দ্য রিপোর্টকে জানান, বর্তমান কমিশন কাউকে ধরছে আর কাউকে ছাড়ছে। তদবির ও স্বজনপ্রীতির কারণে অনেক দুর্নীতির অনুসন্ধান চলছে বছরের পর বছর। আবার অনেক অভিযোগের তদন্তই আটকে যাচ্ছে মাঝপথে। কারও কারও বিরুদ্ধে তদন্ত আবার গতিও পাচ্ছে একই কারণে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশনকে আইনি সক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দল, জনপ্রতিনিধি ও সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং জালিয়াতির দায়ে মামলা করে আইনের আওতায় নিয়ে আসায় দুদকের ওপর মানুষের প্রত্যাশা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে ফল অর্জনের ক্ষেত্রে দুদক সক্রিয়তা দেখাতে পারেনি।’
দুদকের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জন্মলগ্ন থেকেই দুদকের ওপর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপ ছিল, এখনও রয়েছে।’
কমিশনের নেতৃত্বের ওপর গুরুত্বারোপ করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুদকের নেতৃত্বে আরও দৃঢ়তা প্রয়োজন। দুদকের যতটুকু আইনি শক্তি ও জনবল রয়েছে তার মধ্যে থেকেই কমিশন যথাযথ কাজ করলে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনেকটা পূরণ হতো।’
‘দুদকের অবস্থান ও সরকারের অবস্থান অনেক সময় এক হয়ে যায়। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণে কমিশনকে আরও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে।’ বলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক।
ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, ‘কমিশনের এ যাবৎকালে কী অর্জন এবং কেন? আর কী ব্যর্থতা এবং তা কেন?— এ সব নিয়ে নতুন কর্মপরিকল্পনা করে দুদককে অগ্রসর হতে হবে। এ ক্ষেত্রে কমিশন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারে।’ দুদকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে অভিনন্দন জানান তিনি।
দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে দৃশ্যমান অনেক অগ্রগতি হয়েছে। আমাদের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ রয়েছে। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যদিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়। তারপরও আমি মনে করি, দুদক জনগণের প্রত্যাশা পূরণে পুরোপুরি ব্যর্থ নয়।’
দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘বর্তমান কমিশন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি কার্যকর। স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতায় দুদক দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে। বর্তমান কমিশন কাউকে ভয় করে না।’
দুদক সূত্র জানায়, কমিশন ২০০৭ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে মোট তিন হাজার ৬৬২টি মামলা দায়ের করেছে। কমিশন ২০০৭ সাল থেকে ২০১৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মোট তিন হাজার ৭১২টি মামলার চার্জশিট অনুমোদন দিয়েছে এবং দুই হাজার ৩৩৭টি মামলার ফাইনাল রিপোর্ট বা চূড়ান্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে তা নিষ্পত্তি করেছে।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কমিশনের ১৩২টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৬১টি মামলায় সাজা ও ৭১টি মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন। শতকরা হিসেবে প্রায় ৪৬ শতাংশ মামলায় সাজা হয়েছে। ২০১২ ও ২০১৩ সালে এ হার ছিল যথাক্রমে ২৬ ও ৩৬ শতাংশ।
সূত্র আরও জানায়, কমিশনের কার্যক্রম পরিচালনার মূল শক্তি হলো দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ ও এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ জন্য কমিশনের এক হাজার ৭৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।
দুদক সচিব মো. মাকসুদুল হাসান চৌধুরী বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘২১ নভেম্বর তারিখ শুক্রবার সরকারি ছুটির দিন হওয়ায় এর পরিবর্তে ২৩ নভেম্বর তারিখ দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করা হবে।