নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের সাত মাস নূর হোসেন এখনো আওয়ামী লীগ নেতা!
নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর ৭ খুনের প্রধান আসামি নূর হোসেনের বিরুদ্ধে ৭ মাসেও সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদে থাকা এই অভিযুক্ত বর্তমানে ভারতের কলকাতার জেলে বন্দী আছেন। গঠনতন্ত্রের নিয়মানুযায়ী তিন মাসের মধ্যে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। দলটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নূর হোসেন এখনো আওয়ামী লীগ নেতা।
তবে নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগ বলছে, নূর হোসেনকে বহিষ্কারের সুপারিশসংক্রান্ত চিঠি কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীলরা বলছেন, নারায়ণগঞ্জ থেকে নূর হোসেনকে বহিষ্কারের সুপারিশসংক্রান্ত কোনো চিঠি তারা এখনো পাননি।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ‘প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা’ শীর্ষক অংশের ৪৬-এর (ট) উপধারা অনুযায়ী ‘যে কোনো বহিষ্কারের বিষয়ে জেলা কমিটির সুপারিশের পর কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হইলেই কেবল চূড়ান্তভাবে বহিষ্কৃত হইবে এবং অপরাধ প্রমাণিত না হইলে তাহার শাস্তি মওকুফ হইবে। কার্যনির্বাহী সংসদ ৩ মাসের মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবে, নতুবা শাস্তি মওকুফ বলিয়া গণ্য হইবে।’
আওয়ামী লীগ থেকে নূর হোসেনের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বহিষ্কারাদেশ না দেওয়াকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই দেখছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা আইজীবী সমিতির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন। তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘বর্তমান এমপির (শামীম ওসমান) শেল্টার নিয়ে যিনি চলেন, তার মতো নেতাকে বহিষ্কার করা এত সহজ নয়। যত বড় ঘটনাই ঘটুক না কেন, কেন্দ্রেও নূর হোসেনের এমন শুভাকাঙ্ক্ষী আছেন।’
চাঞ্চল্যকর ৭ খুনের ঘটনার প্রধান আসামি সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নূর হোসেনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৭ মাসেও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের একজন সাবেক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য রিপোর্টকে বলেন, বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম গত সরকারের আমলে নূর হোসেনকে সিদ্ধিরগঞ্জের পৌর প্রশাসক করার সুপারিশ করেছিলেন। দফতরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় এক নেতার আশীর্বাদ আছে নূর হোসেনের ওপর। তাই তাকে খুব সহজে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করার ক্ষমতা কারো নেই।
৭ খুনের ঘটনার পর গত ২৪ মে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগ ও নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা দ্য রিপোর্টকে বলেছিলেন, নূর হোসেনকে বহিষ্কারের চিঠি কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। ৭ মাস পর গত ১৩ নভেম্বরও এই নেতারা একই রকম কথা বলেন। এদিন নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘থানা কমিটির সুপারিশ আমরা কেন্দ্রে পাঠিয়েছি। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে কোনো নির্দেশ এখনো পাইনি।’
একই দিন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘নূর হোসেনের বহিষ্কারসংক্রান্ত কোনো চিঠি এখনো পাইনি। চিঠি পেলে আমরা ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি দেখব।’
এতদিনেও চিঠি কেন্দ্রে না পৌঁছানোর বিষয়টি খোকন সাহাকে জানালে তিনি বলেন, ‘আমরা ডাকযোগে চিঠি পাঠিয়েছি। তারা কেন পাননি, তা (আমার) জানা নেই।’
তবে কেন্দ্র চিঠি না পেলেও নূর হোসেন বহিষ্কার হয়েছেন বলেই দাবি করেছেন দলটির শীর্ষ দুই নেতা। প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘মহানগর কমিটি যখন সুপারিশ করে কেন্দ্র বরাবর চিঠি পাঠায়, তখনই নূর হোসেন বহিষ্কার হয়েছেন। উনি (নূর হোসেন) যে লেভেলের নেতা, তাতে এর চেয়ে বেশি কিছুর দরকার নেই।’
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও দলটির ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা আহমদ হোসেন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘নূর হোসেনকে স্থানীয়ভাবে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সে এমন কোনো নেতা না যে, তাকে নিয়ে কেন্দ্রের মাথা ঘামাতে হবে।’
‘আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত ছাড়া তো কাউকে বহিষ্কার করা যায় না …।’— এমন প্রসঙ্গের বিপরীতে আহমদ হোসেন বলেন, ‘লিখে দেন, হি ইজ এক্সপেলড।’ বহিষ্কারের কাগজ কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওর মতো নেতার জন্য এতকিছু লাগে? লিখে দেন এক্সপেলড।’
৭ মাসেও পৌঁছেনি চিঠি
৭ খুনের ঘটনার পর নূর হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার ১০ দিনের মাথায় (৭ মে) সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি বৈঠক ডেকে তাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত পাঠায় নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের কাছে।
এরপর নারায়ণগঞ্জ মহানগর কমিটি কেন্দ্র বরাবর চিঠি পাঠানোর কথা বললেও গত ৭ মাসে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অফিসে ওই চিঠি না পৌঁছানোর বিষয়টি দ্য রিপোর্টকে নিশ্চিত করেছেন দফতর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের শিমরাইল এলাকায় দুটি গাড়ি থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, সিনিয়র আইনজীবী চন্দন সরকারসহ ৭ জনকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। ৩০ এপ্রিল ৬ জন ও ১ মে একজনের লাশ পাওয়া যায় শীতলক্ষ্যা নদীতে।
২৭ এপ্রিল নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি নূর হোসেনকে প্রধান আসামিসহ ১২ জনের নামোল্লেখ করে এবং বেশ কয়েকজন অজ্ঞাতপরিচয়ের বিরুদ্ধে ফতুল্লা থানায় একটি মামলা করেন। এখনো মামলার চার্জশিট দেয়নি পুলিশ