ছড়ায় পরিবর্তনের প্রয়াস

Home-1ফারুক নওয়াজ
সাহিত্যের সবচে’ বদলে যাওয়া শাখাটা— কবিতা। বাংলা কবিতার ভোরের পাখি— বিহারী লাল। তিনি প্রধানত গীতিকবি। আর তিনিই কবিতার পুরনো ধাঁচটা থেকে বের হয়ে এসেছিলেন সহজেই। কবিতাকে তিনি আধুনিক দরোজার পাটাতনে এনে রেখে দেন।
রবীন্দ্রনাথের ভাবগুরু বিহারী লাল। রবিঠাকুর কৈশোরে বিহারী লাল হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার চেয়ে অনেক অনেক দূর পৌঁছে হয়ে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। না, তখনো ভাষাগত ও আবহে রবীন্দ্রনাথ পুরো আধুনিক হয়ে উঠতে চাননি। তার আবেগ তাকে কখনো কখনো সনাতনবাদীতেই আটকে রাখে। তা পাশ্চাত্যের অধুনা বাতাস যখন ভর করল কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালী কবিসমাজে তখন রবীন্দ্রনাথ অনেকটা বাধ্য হয়েই ছন্দের চৌকাঠ পেরিয়ে মুক্তক হয়ে উঠলেন। শুধু তা-ই নয়; তিনি রীতিমতো গদ্যকবিদের সৃষ্টিকেও পুরোটা গদ্যকবিতা হয়ে ওঠেনি বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন, পদ্যগন্ধী গদ্যকবিতা। এটা তিনি মেনে নিতে পারেননি। বলেছেন, গদ্যগন্ধী পদ্য বা পদ্যগন্ধী গদ্য— এটার বাইরে কেউ বের হতে পারছেন না।
হ্যাঁ, পরে কিন্তু কবিতা পুরোটা পদ্যের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। এই বেরিয়ে আসা, এটাই হচ্ছে কবিতার বদলে যাওয়ার বিপ্লব।
আমাদের বাংলা কবিতার এই বদলে যাওয়ার ফলে কবিতার উত্তরণ ঘটেছে কি না বলতে পারব না, তবে কবিতা যে বদলেছে— এটা আধুনিক কবিদের অবদান। এক্ষেত্রে ছড়া কিন্তু সেকেলেই হয়ে রয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে `ছড়া’ কবিতার একটি রূপ। কিন্তু ছড়া তো ছড়াই। এটার মধ্যে একটা ছড়-ছড়ানো শব্দ থাকতেই হয়। এটা ছান্দিক গতি বা ঝর ঝর, শন শন, বন বন বা খুকুর হাতের ঝুমঝুমির শব্দ যদি ছড়াতে না থাকে তাহলে সেটা ছড়া হবে কেন?
এ জন্যই ছড়া ছড়াই রয়ে গেছে। অবশ্য এই যে ছন্দের বাঁধন— এই বন্ধন থেকেও ছড়াকে আধুনিক করার প্রয়াস চলে আসছে।
এক্ষেত্রে অন্নদাশঙ্কর রায়, অমিতাভ চৌধুরী, আবদার রশীদ— এমন হাতেগোনা কজনকে ছড়ার এই ঈষৎ বদলানোর পথিকৃত বলব।
222সেই পথ ধরে হাঁটার প্রয়াস চালিয়েছেন অনেকেই| কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে আবার সেই পুরনো জায়গাতেই ফিরে এসেছেন।
বলতে দ্বিধা নেই যে, হালে অতিতরুণ এবং নবীনদের মধ্যে বদলানোর তোড়টা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কিন্তু এখানেও সমস্যা— তারা বদলাচ্ছেন নিরীক্ষার ঢঙে। ফলে সেটা সেই `সোনার পাথরবাটি’ হয়ে যাচ্ছে। সেখানে প্রাণ থাকছে না, অর্থ ও ভাবে কেমন বিভ্রাট ঘটে চলেছে। তা হৃদয়েও ধারণ করা যাচ্ছে না। মস্তিষ্কেও জায়গা করতে পারছে না। এমন এক লেজে-গোবরে অবস্থা থেকে হাতেগোনা দু’য়েকজন যেন সত্যিই চমকে দিচ্ছেন। এমনই এক চমকদারী ছড়ার বদলে দেওয়ার `বোদলেয়ার’—আমাদের জগলুল হায়দার।
333তার আবির্ভাব হয়তো বেশ আগে, তবে বছর ১৪ কি তার দু’-এক বছর আগে বা পরে ইত্তেফাকের কচিকাঁচার আসরে তার ছড়ায় আমার চোখ পড়ে। বেশ ঘন ঘন দেখতে পাই। তারপর তো আজকের `জগলুল হায়দার’ হয়ে উঠেছেন তার নিজগুণেই।
জগলুলের মধ্যেও নিরীক্ষার অভ্যাস সবসময়, কিন্তু সেই নিরীক্ষাপ্রবণতা ছড়াকে তার চিরকালের আবেদন থেকে কিছুমাত্রও বিচ্যুৎ করেনি। সব মিলিয়ে এখন জগলুল প্রায় ত্রিশটার মতো বইয়ের রচয়িতা। গড়ে ৩০টা হলে মলাটবদ্ধ ছড়ার সংখ্যা দাঁড়ায় নয় শ’। ছয় শ’ ছড়া কি কম?
বলব, সেই ৯০০ ছড়ার একটাও কিন্তু বাদ দেওয়ার মতো নয়। সেখানে প্রাণ আছে, আবেগ আছে, আছে আধুনিক ভাবনার দুর্দান্ত এক্সারসাইজ। যেমন—
last“আমার আছে—
হোমওয়ার্ক-টিউটোরিয়াল
নিত্য পাঠ ও জানা—
পাখির আছে ডানা।
পাখির আছে উড়াল আকাশ
আমার কিন্তু—
বাইরে যেতেই মানা।” (খাঁচা)
অথবা
“এটাই আমার দোষ
দোষ কি এটা বাবা?
আদর করে বলো যদি
আইসক্রিম খাবা—
আমি কেন না করব
বরং ঠিকই হা করব
খেতে
আম্মু তাতে রেগেই ওঠেন
তেতে।…” (মা কেন হয় রাগ)
উদ্ধৃত দু’টো ছড়াতেই তার আধুনিকবোধের জলজ্যান্ত পরিচয়টা যেমন পাই, তেমনি ছড়ার পুরনো আদল থেকে বেরিয়ে আসার স্পর্ধাও দেখি।
এ রকমই বদলানোর খেলায় মগ্ন জগলুল। উদ্ধৃত ছড়া দু’টি তার যে বই থেকে নেওয়া সে বইটির নাম `তা রা রা তা রা রা তারারে’| এই নামের মধ্যেও বদলে যাওয়ার প্রচণ্ড প্রয়াস সন্দেহাতীতভাবে স্পষ্ট। এই `তা রা রা তা রা রা তারারে’এর মোট ১৭টি ছড়ার মধ্যেই বদলানোর গন্ধ প্রকট। বিশেষ করে এলার্ম, আকাশ কি মা, তাই না, জ্যাক আর জুঁই, ভেন্টিলেটার, ইজি, জাগতে জাগতে ঘুম, এবং গ্রন্থের শিরোনাম ছড়ায় জগলুলের বদলানোর জাদু পাঠককে নতুনত্বের ঝাঁঝে চমকিত করবে।
এ তো গেল তার বদলানোর খেলা। এরপর যেটি না বললেই নয়, তা হল— জগলুল কিন্তু স্রেফ ছড়-ছড়ানো ছড়ার কারিগর নন, তিনি প্রকৃত অর্থে কবি। হয়তো ছড়ার কবি বা কবিতার ছড়াকার। ছড়ার ভেতরে তার দু’টো ব্যাপার মেখে থাকে— তা হল মস্তিষ্ক আর আবেগ। আবেগে তা যেমন ভেসে যায় না, আবার মস্তিষ্কের কোষে তা একেবারে বিঁধেও থাকে না। দু’টোর মিশেলে সে সব অনন্য শিল্প হয়ে ওঠে।
এ কথা আমার মধ্যে সব সময় মনে হয়— বড় কবি না হলে সেরা ছড়া লেখা অসম্ভব। ছড়ার কবিকে ছন্দের আদ্যোপান্ত জানতে হয়। ছন্দের খেলাটা, ধাঁচটা, রংটা, আকৃতি-মাপজোকটা এবং সর্বোপরি তার ব্যবহারটা যে বোঝে না সে নিরেট অকবি। অছড়াকার।
জগলুল এ থেকে নিরাপদ। তার ছোট্ট বই ‘ভাবতে ভাবতে একটা ছেলে’।

এটাকে ছড়ার মধ্যে ফেললেও প্রকৃত অর্থে এটা একটা সম্পূর্ণ কবিতার বই। নিখাঁদ-নিরঙ্কুশ কবিতা। যেমন— “একটা ছেলে ভাবতে ভাবতে/নিজেই একটা আকাশ হলো/ সেই আকাশে নীল হলো/দুইটা শঙ্খচিল হলো/ সেই ছেলেটা সুখ পেতে/ নিজেই নিজের বুক পেতে/ এমন হলো—/তুমিই বলো, এবার বলো/ কেমন হলো!” (একটা ছেলে)
কী বলব এটাকে? ছড়া, না কবিতা?
বলব, ষোলো আনাই ছড়া আবার ষোলো আনাই কবিতা।
জগলুল হায়দারের জন্মদিন। ৪৯ বসন্ত পেরিয়ে অর্ধশত বসন্তের দিকে এগিয়ে চলেছেন। একজন প্রকৃত কবির বয়সের শুরুই হয় চল্লিশের পর। আরও বর্ণাঢ্য-বিচিত্র অনেক বসন্ত তার অপেক্ষায় আছে।
তাকে নিয়ে লেখার সময় অনেক প্রলম্বিত। তার সৃষ্টির অরণ্য অসংখ্য বর্ণিল-সুগন্ধী ফুলে সেজে উঠবে— সেদিনের জন্য আগামী দাঁড়িয়ে আছে।
লেখক : প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক ও কবি

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend