গণমাধ্যমের দায়িত্ববোধ ও ছাত্রলীগের ‘ভালো কাজ’
গণমাধ্যম রাজনীতিবিদদের দোষত্রুটি নিয়ে কথা বলে। একজন রাজনীতিবিদ বা মন্ত্রী কী করলেন, কেন করলেন, তার কাছে কী প্রত্যাশা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গণমাধ্যম সোচ্চার থাকে। সমালোচনা লেখা হয়। টেলিভিশনের টকশো হয় তীব্র সমালোচনামুখর।
গণমাধ্যম যাদের নিয়ে কথা বলে, তারা গণমাধ্যম নিয়ে কথা বলবেন- সেটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। টকশোতে রাজনীতিবিদ, সরকারের সমালোচনা হবে, আর রাজনীতিবিদ-মন্ত্রীরা টকশোর সমালোচনা করবেন না, তা কী করে হয়? তাদের সমালোচনাকে একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে মোটেই খারাপভাবে দেখি না। সমালোচনাকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষা নিতে চাই, যদি শিক্ষা নেয়ার কোনো উপাদান থাকে। একইভাবে প্রত্যাশা করি, গণমাধ্যমের সমালোচনা থেকে রাজনীতিবিদ-মন্ত্রী সর্বোপরি সরকার ভুল-ত্রুটি শুধরে নেবে, সবকিছু অস্বীকার না করে। ভুল বা অসত্য সমালোচনা হলে, প্রতিবাদ আসুক। গণমাধ্যমের দায়িত্ব হবে, নিজেকে সংশোধন করে নেয়া।
গণমাধ্যমে যা লেখা হয়, গণমাধ্যমে যা বলা হয়, দায়িত্ব নিয়েই লেখা-বলা হয়। সব দায়িত্বশীল গণমাধ্যমই ভুল হলে সংশোধন করে নেয়, দুঃখ প্রকাশ করে। অনেক ক্ষেত্রে তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হয়।
গণমাধ্যম যখন কোনো ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান, রাজনীতিবিদ-মন্ত্রীর অনিয়ম-অনৈতিকতা নিয়ে লেখে, তখন তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে লেখে-বলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট করেই লেখে। কিন্তু এসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যখন অভিযোগ খণ্ডন করে কথা বলা হয় বা প্রতিবাদ করা হয়, তখন তাতে মোটেই সুনির্দিষ্ট অভিযোগের জবাব থাকে না।
গণমাধ্যম কীভাবে লিখবে, কী লিখবে, কী বলবে, কীভাবে বলবে- বিষয়গুলো নিয়ে সারাক্ষণ কথা বলেন রাজনীতিবিদ-মন্ত্রীরা। কিন্তু নিজেরা কীভাবে কথা বলবেন, সে বিষয় নিয়ে একটুও ভাবেন না। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়া মিথ্যা অভিযোগ করেন। তথ্যপ্রমাণ ছাড়া গণমাধ্যম কথা বলবে না, বলতে পারে না। বললে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হয়, হবে। তথ্যপ্রমাণ ছাড়া রাজনীতিবিদরা কেন কথা বলবেন? কেন একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে অশালীন ভাষায়, কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত করে বিষোদ্গার করবেন?
২.
‘ছাত্রলীগ কোথাও কিছু করলেই সেটা পত্রিকাগুলো বড় করে দেয়। পত্রিকাগুলোর সেনশনাল নিউজ না হলে চলে না। ছাত্রলীগ যে ভালো কাজ করে সেটা খবরে আসে না।’
কথাগুলো বলেছেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়।
‘ভালো কাজ’ বলতে এটিএন নিউজের একটি অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল বলেন, ছাত্রলীগ রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় আহতের পাশে দাঁড়িয়েছে, রক্ত দিয়েছে। নাজমুলের সেই বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি শোনা গেল সজীব ওয়াজেদ জয়ের মুখে। জয় ‘ভালো কাজ’ সম্পর্কে আরও বলেছেন, ‘ছাত্রলীগ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু তা কখনো গণমাধ্যমে আসে না।’
মুন্নী সাহা তার অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক নাজমুলের কাছে জানতে চেয়েছিলেন গত কয়েক বছরে ছাত্রলীগের করা তিনটি ‘ভালো কাজে’র কথা। বিস্ময়করভাবে লক্ষ করলাম, সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর একেবারেই সুনির্দিষ্ট নয়, অনেক ঘোরানো পেঁচানো।
ধরে নিলাম টেলিভিশনের অল্প সময়ের আলোচনায় ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক হয়ত ভালো কাজগুলো সুনির্দিষ্ট করে তুলে ধরতে পারেননি। সমস্যা নেই, এখনও কাজটি করার সুযোগ আছে। বিশেষ করে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বক্তব্যের পর ছাত্রলীগের এখন দায়িত্ব ভালো কাজগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরা, যা দেখে গণমাধ্যম অন্তত একটু লজ্জা পাবে এটা ভেবে যে, এত ‘ভালো কাজ’ আমরা তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছি।
এখন আসা যাক ‘ভালো কাজে’র নমুনা আর ‘কোথাও কিছু করলেই’ প্রসঙ্গে।
ক. ‘ভালো কাজে’র নমুনায় সুনির্দিষ্ট করে নমুনা পাওয়া যাচ্ছে একটি- রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর পাশে দাঁড়ানো।
খ. দ্বিতীয়টির কথা বলা হচ্ছে, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে অগ্রণী ভূমিকা পালন। ‘বিভিন্ন’ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানে কোন কোন দুর্যোগ? সুনির্দিষ্ট করে কি বলা যায়? কোন দুর্যোগের ঠিক কী অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে ছাত্রলীগ?
গ. ছাত্রলীগের ভালো কাজের নমুনায় দুর্যোগে পাশে দাঁড়ানো ছাড়া আর কিছু না থাকার কারণ কী?
ঘ. গত ছয় বছরে ছাত্রছাত্রীদের সমস্যার সমাধান ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কী করেছে ছাত্রলীগ?
ঙ. তার আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে কী কী দায়িত্ব পালন করেছে ছাত্রলীগ? ‘ক্ষমতার বাঘ ছাত্রলীগ’ সেই দুই বছর কী ছিল? মতিয়া চৌধুরী বলেছিলেন, ‘বিড়াল’। আমরা সেটা বলছি না। তবে ছাত্রলীগ নিজেরা পরিষ্কার করে তাদের সেই সময়ের কথা তুলে ধরতে পারে।
৩.
‘কোথাও কিছু করলেই’… ছাত্রলীগ আসলে কোথাও কী করে? কেন পত্রিকাগুলো ‘বড় করে দেয়’?
গত ছয় বছরের ‘কোথাও কিছু করলেই’-এর অসংখ্য ঘটনা থেকে কয়েকটি নমুনা-
চ. অতি নিরীহ বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যা।
ছ. দলীয় কোন্দলে একপক্ষের গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ফারুক হত্যা।
জ. জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের প্রকাশ্য সন্ত্রাস-গুলি-হত্যাকাণ্ড। ছয়তলা হলের ছাদ থেকে একজনকে ফেলে দেয়া। অস্ত্র হাতে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের ছবি পত্রিকায় ছাপা হওয়া। ঠিকাদারি নিয়ে দু’পক্ষের গুলি-সন্ত্রাস।
ঝ. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্র হাতে ছাত্রলীগের সন্ত্রাস। অস্ত্রসহ ছাত্রলীগ নেতা-ক্যাডারদের ছবি পত্রিকায় প্রকাশ। এক পক্ষ আর এক পক্ষকে প্রকাশ্যে রাম দা দিয়ে কোপানোর ছবি পত্রিকায় প্রকাশ।
ঞ. চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিকবার ছাত্রলীগের তিন গ্রুপের প্রকাশ্যে অস্ত্র-সন্ত্রাস। ক্যাম্পাস অকার্যকর করে দেয়া। চলন্ত ট্রেন থেকে একজনকে ফেলে দিয়ে হত্যা।
ট. সিলেটের মদনমোহন কলেজের ইতিহাসের সাক্ষ্য ঐতিহ্যবাহী ছাত্রাবাস আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া। যারা আগুন দেয়, সন্ত্রাস করে, তাদের ছবি পত্রিকায় প্রকাশ। হলের সামনে দাঁড়িয়ে অসহায় শিক্ষামন্ত্রীর কান্নার ছবিও প্রকাশ করে গণমাধ্যম। অপরাধী ছাত্রলীগের নেতারা প্রকাশ্যে ঘুরছে, গণমাধ্যম জানায় সেই তথ্যও।
ঠ. এক পক্ষের হয়ে আরেক পক্ষের জমি দখল করতে গেছে ছাত্রলীগ নেতা-ক্যাডাররা। সারাদেশের এমন অনেক ঘটনা গণমাধ্যমে উঠে এসেছে।
ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রীদেরও নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে ছাত্রলীগ নেতা-ক্যাডাররা।
ড. সারাদেশের বড় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের একাধিক গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। দুই বা তিন পক্ষকে অস্ত্র, রামদা, কুড়াল হাতে প্রকাশ্যে দেখা গেছে। পুলিশের পাশেই অস্ত্র হাতে দেখা গেছে ছাত্রলীগ ক্যাডার-নেতাদের।
ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষ হেেছ। দুই দলের অস্ত্রধারীদের ছবি ছাপা হয়েছে গণমাধ্যমে। ছাত্রলীগের কয়েকজন আক্রান্ত-হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। ছাত্রলীগও আক্রমণ করেছে, হত্যা-জখম করেছে। এ সবকিছুই গণমাধ্যমে এসেছে।
৪.
এমন আরও অনেক নমুনা তুলে ধরা যায়। সেদিকে আর যাচ্ছি না। যে ঘটনাগুলো উল্লেখ করলাম সেই ঘটনাগুলোর বিষয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কী ভূমিকা পালন করেছেন?
আওয়ামী লীগ নেতাদের এমনকি প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানই বা কী ছিল?
ঢ. সরকারের মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেছেন, ছাত্রলীগের এসব কর্মকাণ্ডের দায় আওয়ামী লীগ নেবে না।
ণ. আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ বলেছেন, ছাত্রলীগের ভেতরে শিবির ঢুকে গেছে। একজনকেও শিবির হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে- এমন কোনো তথ্য আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি।
ত. গণমাধ্যমে এসেছে, প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের এসব কর্মকাণ্ডে অভিমান করে দূরে সরে গেছেন, সাময়িক সময়ের জন্যে হলেও।
থ. এক একটি সন্ত্রাস-হত্যা-চাঁদাবাজি ঘটনার পর ছাত্রলীগ মূলত দুটি কাজ করেছে। অভিযুক্ত কয়েকজনকে সাময়িকভাবে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছে। কোনো কোনো জায়গায় কমিটি স্থগিত করেছে। কিছুদিনের মধ্যেই তাদেরকে আবার ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে দেখা গেছে। একইভাবে সন্ত্রাস করেছে, করছে।
দ. সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ ক্যাডারদের বিরুদ্ধে প্রায় কোনো আইনগত ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি প্রশাসনকে, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ছাড়া।
ধ. প্রথমে বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের ছাত্রলীগ বলে স্বীকার করা হয়নি। ক্রমাগত গণমাধ্যমের চাপে বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছে সরকার।
৫.
এসব ঘটনা যদি হয় ‘কোথাও কিছু করলেই’ আর ‘দুর্যোগে অগ্রণী ভূমিকা’ (তাও সুনির্দিষ্ট নয়) যদি হয় ভালো কাজের নমুনা তাহলে আর বলার কী আছে!
এখন ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের কাছে অনুরোধ করি, আপনাদের ভালো কাজের একটি তালিকা প্রকাশ করুন। সুনির্দিষ্টভাবে প্রকাশ করুন। এবং আপনাদের বিরুদ্ধে যে অকর্মের অভিযোগ (সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি-মাস্তানি-হত্যাকাণ্ড) সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করুন।
গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে এতে আমরা উপকৃত হব। আপনারা ‘কোথাও কিছু করলেই পত্রিকাগুলো বড় করে দেয়’ তার সুনির্দিষ্ট জবাব হতে পারে, ভালো কাজের তালিকা এবং অভিযোগের জবাব।
যা থেকে গণমাধ্যম তার দায়িত্ববোধ বিষয়ে শিখতে পারবে।
প্রত্যাশায় রইলাম তালিকা দেখার, বক্তব্য জানার।