মহাসচিব হতে চান মিয়াজী ক্ষমতার দ্বন্দ্বে খেলাফত আন্দোলনে অসন্তোষ
হাফেজ্জী হুজুর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনে নেতৃত্ব নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর পরিবার ও এর বাইরে থাকা নেতাদের দ্বন্দ্বে এ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে দলটির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে চলছে অসন্তোষ ও অবিশ্বাস।
শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতার কারণে আমীরের দায়িত্ব থেকে আপাতত দূরে সরে আছেন হাফেজ্জী হুজুরের বড় ছেলে মাওলানা শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফ। ভারপ্রাপ্ত আমীরের দায়িত্বে আছেন তার ছোট ভাই হাফেজ মাওলানা আতাউল্লাহ। কিন্তু আহমাদুল্লাহ আশরাফের ছেলেদের কেউ কেউ চাচ্ছেন তাদের বাবাই আমীরের পদে থাকুক। এমনকি মহাসচিব পদেও আহমাদুল্লাহ আশরাফের দ্বিতীয় ছেলে মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী আসীন হতে নানা তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। আর এ পরিপ্রেক্ষিতে মহাসচিব পদ থেকে চাপ দিয়ে কৌশলে জাফরুল্লাহ খানকে সরিয়েও দিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়, আগামী ২৯ নভেম্বর মজলিশে শূরার বৈঠকে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে যাতে মহাসচিব পদে জাফরুল্লাহ খান প্রার্থী না হন এ জন্য ওয়াদাও নিয়েছেন তিনি।
দলের এক জরুরি বৈঠক শেষে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পদত্যাগ করেন দীর্ঘ প্রায় ২৭ বছর ধরে খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব পদে দায়িত্ব পালনকারী মাওলানা জাফরুল্লাহ খান।
এ ব্যাপারে খেলাফত আন্দোলনের পদত্যাগী মহাসচিব মাওলানা জাফরুল্লাহ খান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘কামরাঙ্গীরচর জামেয়া নুরিয়া মাদরাসা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে সঙ্কট চলে আসছিল। কারণ মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ হুজুর শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে যাওয়ার পর তার দ্বিতীয় ছেলে মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী এককভাবে সবকিছু করছিলেন বলে তার অন্য ভাইয়েরা অভিযোগ করে আসছিলেন। মিয়াজীর অন্য ভাইয়েরা (তারা মোট ৯ ভাই ও ৮ বোন) চাচ্ছিলেন তাদের বাবা আহমাদুল্লাহ আশরাফের অনুপস্থিতিতে সবাইকে নিয়েই যেন মাদরাসা পরিচালনা করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘কাল (বৃহস্পতিবার) জরুরি একটা বৈঠক ছিল। ওই বৈঠকে আমি মিয়াজী সাহেবকে বলি আপনিও ভাইস প্রিন্সিপাল থাকেন সঙ্গে আপনার ভাই মুফতী মুহিবুল্লাহ সাহেবকেও ভাইস প্রিন্সিপাল বানানো হোক। সবাই মিলেই মাদরাসা পরিচালনা করেন। এ পর্যায়ে মিয়াজী সাহেব বলে ওঠেন ঠিক আছে এটা করতে পারি, তবে— শর্ত হল খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব পদ থেকে জাফরুল্লাহ খানকে পদত্যাগ করতে হবে। আমি তখন বলি ঠিক আছে, যদি আমি পদত্যাগ করলেই সমস্যার সমাধান হয় তাহলে আমি এতে রাজি।’
‘কিন্তু মাদরাসা পরিচালনার বিষয় নিয়ে খেলাফত আন্দোলন থেকে আপনার পদত্যাগের বিষয়টি এলো কেমন করে?’— এমন প্রশ্নের জবাবে জাফরুল্লাহ খান বলেন, বিষয়টি আমারও বুঝে আসছে না। কেন মিয়াজী সাহেব আমাকে পদত্যাগ করতে বললেন। শুধু তাই নয়, মিয়াজী সাহেব আমাকে বলেন, আগামী ২৯ নভেম্বর খেলাফতের মজলিশে শূরার বৈঠক। ওখানে আমি মহাসচিব পদে প্রার্থী হতেও পারব না। আমি এতেও রাজি হয়ে গেলাম। কারণ গঠনতন্ত্র ও ইসলামী নিয়ম অনুযায়ী তো কেউ খেলাফতের মহাসচিব পদে প্রার্থী হতে পারবেনই না। সাথে আমি তাকে শর্ত দিলাম— আপনার আরেক ভাই মুফতি এনায়েত উল্লাহকে মাদরাসার শিক্ষা সচিব করতে হবে, বড় ভাই হাফেজ ওলিউল্লাহকে হেফজ বিভাগের প্রধান এবং ভগ্নিপতি মাওলানা আব্দুল্লাহকে মাদরাসা পরিচালনা পরিষদের সদস্য বানাতে হবে। আমার প্রস্তাবে মিয়াজী সাহেব রাজি হওয়ায় আমি পদত্যাগ করি। এটা ওনাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানের স্বার্থেই করেছি।’
আপনার বিরুদ্ধে জামায়াত কানেকশনের অভিযোগ থাকার কারণেই কী আপনাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে?— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এ অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমাকে ঘায়েল করার জন্যই দলের মধ্যে একটি গ্রুপ এ সব ভিত্তিহীন অভিযোগ করছে। কারণ আমি খোলামনে যে কোনো ইসলামী ইস্যুতে আন্দোলনে থাকি। তাই আওয়ামীপন্থীরা এ সব অপপ্রচার চালায় আমার বিরুদ্ধে। আমি কখনই জামায়াতের আদর্শে বিশ্বাসী নই। আমার এ পর্যন্ত ৪০-৪৫টি বই বেরিয়েছে। সব কটি বইয়েই জামায়াতের আকিদাকে ভ্রান্ত বলে উল্লেখ করেছি। সুতরাং আমাকে এ সব অভিযোগ দিয়ে কেউ কেউ দলে সুবিধা নিতে চাইছে।’
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন মাওলানা হাফেজ্জী হুজুর প্রতিষ্ঠিত একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল। নির্বাচন কমিশনে দলটির নিবন্ধনও রয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর মারা যাওয়ার পর দীর্ঘদিন ধরে দলটির প্রধান আমীরে শরীয়তের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তার বড় ছেলে মাওলানা শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফ। বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থতা ও শারীরিকভাবে দুর্বল হওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শে বিশ্রামে রয়েছেন তিনি। বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত আমীরের দায়িত্ব পালন করছেন তার ছোট ভাই এবং দলটির নায়েবে আমীর হাফেজ মাওলানা আতাউল্লাহ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খেলাফতের আরেক কেন্দ্রীয় নেতা দ্য রিপোর্টকে বলেন, শারীরিকভাবে দুর্বল হওয়ার কারণে মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ আমীরের পদ থেকে বাদ পড়ছেন। তার ছোট ভাই বর্তমান ভারপ্রাপ্ত আমীর হাফেজ মাওলানা আতাউল্লাহই আগামী ২৯ নভেম্বরের মজলিশে শূরার বৈঠকে আমীর হচ্ছেন। কিন্তু এটাকে ভাল চোখে না দেখলেও ঠেকাতে পারছেন না আহমাদুল্লাহ আশরাফের দ্বিতীয় ছেলে হাবিবুল্লাহ মিয়াজী।
তাই তিনি যাতে কমপক্ষে দলের দ্বিতীয় শীর্ষ পদ মহাসচিব হতে পারেন এ জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তার অনুসারীদের নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই নানা তৎপরতা চালাচ্ছেন। মহাসচিব হতে না পারলে কামারাঙ্গীরচর জামেয়া নুরিয়া মাদরাসার পরিচালনা পর্ষদ এমনকী ভাইস প্রিন্সিপালের পদ থেকেও তাকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে। কারণ তার বাবা আহমাদুল্লাহর অনুপস্থিতিতে চাচা মাওলানা আতাউল্লাহ এমনিতেই ওই মাদরাসার প্রথম হকদার। তিনি যদি আবার দলের আমীর হয়ে যান তাহলে সব কর্তৃত্ব তার হাতেই যাবে।
তবে ওই নেতার দাবি মজলিশে শূরার অধিকাংশ সদস্যই জাফরুল্লাহ খানের পক্ষে। কারণ মিয়াজীকে সবাই বদমেজাজি একগুয়েমী হিসেবেই চেনেন। তার আচরণে অধিকাংশ নেতাকর্মীই সন্তুষ্ট নন। মজলিশে শূরার ভোটে জাফরুল্লাহ খান আবারও মহাসচিব নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি বলে মনে করেন দলটির এ নেতা।
এ ব্যাপারে খেলাফত আন্দোলনের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যার কারণেই জাফরুল্লাহ খান সাহেব পদত্যাগ করেছেন। তা ছাড়া তিনি যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে দলের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন তাই আগামী ২৯ নভেম্বর মজলিশে শূরার বৈঠকে যাতে নতুন কেউ ওই পদে আসতে পারেন এ কারণেই তিনি সরে দাঁড়িয়েছেন। উনি বলেছেন যে, মজলিশে শূরার বৈঠকে যদি মহাসচিব পদে কেউ ওনার নাম প্রস্তাবও করেন তাহলে তিনি ওই পদে যেতে রাজি হবেন না। ওনাকে মহাসচিব পদ থেকে পদত্যাগ করতে আপনিই কি বলেছিলেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এ রকমই, আমাদের পক্ষ থেকে ওনাকে কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছিল। উনিও আমাদের কিছু শর্ত দিয়েছেন।’
আপনিই কি আগামী দিনের মহাসচিব হচ্ছেন? জানতে চাইলে হাবিবুল্লাহ মিয়াজী কিছুটা আমতা আমতা করে বলেন, সেটা মজলিশে শূরার বৈঠকেই ঠিক হবে। এ ছাড়া এ পদে আরও অনেকেই রয়েছেন। মজলিশে শূরা যাকে ভাল মনে করবেন তাকেই মহাসিচব বানাবেন।
জাফরুল্লাহ খানের বিরুদ্ধে জামায়াত কানেকশনের কোনো অভিযোগ আপনাদের পক্ষ থেকে আছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে সরাসরি এ ধরনের প্রমাণ দেখি নাই। তবে পত্রপত্রিকায় দেখি তার নাকি জামায়াত প্রীতি রয়েছে।’
খেলাফত আন্দোলনের আমীর-মহাসচিবসহ পুরো কমিটিই তো মেয়াদ উত্তীর্ণ। তাহলে কি দুই পদেই নির্বাচন হচ্ছে? আপনার চাচা কী স্থায়ীভাবে আমীর হচ্ছেন? জানতে চাইলে মাওলানা মিয়াজী বলেন, ‘হ্যাঁ তা ঠিক। দুই পদেই নির্বাচন হচ্ছে। তবে আমার বাবাই আমীর থাকছেন। কারণ তিনি আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠছেন।’