পদ ধরে রাখতে জবি ছাত্রলীগের শীর্ষ ২ নেতার কৌশল
মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিতে পদ ধরে রাখতে কৌশল নিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতা। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের প্রভাব স্থায়ী করতে ছাত্রলীগের বিভাগভিত্তিক কমিটি করার অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে।
১১ নভেম্বর বাংলা ও অর্থনীতি বিভাগের সম্মেলনের মাধ্যমে জবি ছাত্রলীগের বিভাগভিত্তিক কমিটি গঠনের কার্যক্রম শুরু হয়।
জবির বিভিন্ন নির্মাণাধীন ভবনের টেন্ডারের টাকা হাতিয়ে নিতে জবি ছাত্রলীগের সভাপতি এফ এম শরিফুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক এস এম সিরাজুল ইসলাম সংগঠনকে ‘শক্তিশালী’ করার নামে এই কৌশল নিয়েছেন বলে অভিযোগ শাখা ছাত্রলীগ নেতাদের।
জবির কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতার অভিযোগ, কমিটির মেয়াদ দুই বছর পার হওয়ার পর ক্যাম্পাসে বিভাগভিত্তিক কমিটির কার্যক্রম উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এর মধ্যে জবি সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থ যুক্ত রয়েছে।
জানা গেছে, এক বছর মেয়াদের কমিটি বর্তমানে দুই বছর পার করায় জবি ছাত্রলীগের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে। সাংগঠনিক কার্যক্রমও স্থবির। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ায় শীর্ষ ওই দুই নেতাকে তোয়াক্কা না করে ক্যাম্পাসে তৈরি হয়েছে ছাত্রলীগের বেশ কয়েকটি গ্রুপ। শীর্ষ দুই নেতার চেয়ে সাংগঠনিকভাবে এখন তারাই (গ্রুপ) বেশি শক্তিশালী। তাদের দাপটে ক্যাম্পাসে কার্যত কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন জবি ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতা। এর আগে তোপের হাত থেকে বাঁচতে সংগঠনের নিয়ম ভঙ্গ করে নিজস্ব লোকদের মৌখিকভাবে পদায়ন করেছিলেন তারা।
জবি ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের বিরাজমান নানা কোন্দল চাপা দিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বিভাগীয় কমিটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিভাগীয় কমিটি করার মাধ্যমে তারা নিজেদের পদ ধরে রাখার পাশাপাশি পরবর্তী সময়ে জবি ছাত্রলীগে তাদের প্রভাবকে স্থায়ীভাবে ধরে রাখতে চান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জবি ছাত্রলীগের এক নেতা দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘বিভিন্ন বিভাগে ছাত্রলীগের কমিটি দেওয়া হলে কাউন্সিলর তৈরি হবে। আর সেই কাউন্সিলররা হবে জবি ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের একান্ত অনুগত। কারণ বিভাগীয় কমিটিতে মেধাবীদের স্থান না দিয়ে তারা (সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক) তাদের নিজস্ব নেতাদেরই ওই পদে বসাবেন। পরে কাউন্সিল হলে ভোটাভুটির মাধ্যমে তাদের অনুগতদের জবি ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে বসানো যাবে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জবি ছাত্রলীগের প্রথমসারির আরেক নেতা দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আগামীতে জবিতে একাডেমিক ভবন ২০ তলা সম্প্রসারিত, ছাত্রী হলের নির্মাণ কাজসহ বিভিন্ন কাজ রয়েছে। ওই কাজের টেন্ডারের ভাগ নেওয়ার জন্যই তারা বিভাগভিত্তিক ছাত্রলীগের কমিটির কথা বলে আরও কিছুদিন পদ আঁকড়ে থাকতে চান।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জবি ছাত্রলীগের সভাপতি এফ এম শরিফুল ইসলাম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নির্দেশক্রমেই আমরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগে বিভাগ ও অনুষদ পর্যায়ে কমিটি করছি।’ পদ ধরে রাখার জন্য মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর কমিটির কার্যক্রম শুরু করেছেন কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের যা ইচ্ছা আমরা তাই করছি, এ ব্যাপারে আপনি বলার কে? আমাদের বিরুদ্ধে আপনার কাছে কোনো অভিযোগ এলে থানায় মামলা দিন।’
জবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম সিরাজুল ইসলাম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘ছাত্রলীগ একটি গতিশীল সংগঠন। এখানে পদ ধরে রাখার কিছু নেই।’
জবি ছাত্রলীগ সূত্র জানায়, বর্তমান কমিটি নেতৃত্বে আসার আড়াই মাসের মাথায় ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিশ্বজিৎ হত্যার মতো বহুল আলোচিত ঘটনা ঘটে। সে সময় জবি সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধেও ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। এরপর আর কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি জবি ছাত্রলীগ।
ক্ষমতায় থাকার পরও জবি ছাত্রলীগের কর্মীসংখ্যা কমতে থাকে। অপরদিকে বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের সাংগঠনিক অবস্থা ক্যাম্পাসে বেশ শক্ত হওয়ায় চ্যালেঞ্জর মুখে পড়ে জবি ছাত্রলীগের নেতৃত্ব।
বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত জবি ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতা সংগঠনের কর্মীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে এক প্রকার ব্যর্থ হন। পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়া হলেও আবার সাংগঠনিক মূলধারাতে ফিরে আসতে পারেনি রাজধানীতে ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ এই ইউনিট।
শীর্ষ দুই নেতার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ : অভিযোগ আছে- বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে টেন্ডার পাইয়ে দেওয়া, শিক্ষকের মাথায় অস্ত্র ঠেকানো, শিক্ষক পেটানো, চাঁদাবাজি, ছিনতাই থেকে শুরু করে নানা কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেন জবি ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নিয়োগ নিয়ে বাণিজ্য করারও অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
গত ১৩ মার্চ ক্যাম্পাসের রসায়ন বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সৈয়দ আলমকে অস্ত্র ঠেকিয়ে পাঁচ লাখ টাকার টেন্ডার ছিনতাইয়ে নেতৃত্ব দেন জবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম সিরাজুল ইসলাম। ১৫ মার্চ রাতে ‘শিক্ষককে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও হত্যার হুমকির’ অভিযোগে কোতয়ালী থানায় মামলা করেন জবির তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অশোক কুমার সাহা। এ ছাড়া পূর্ণাঙ্গ কমিটি হওয়ার সময় পদপ্রাপ্তদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে জবি ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতার বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি সমবায় ব্যাংকের জমি দখল করে টাকার বিনিময়ে মাঝি লীগের কাছে ভাড়া দেওয়ার অভিযোগও ওঠে জবি ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে তারা বেশ তোপের মুখেও পড়েন।
কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ : ২০১২ সালের ৩ অক্টোবর এফ এম শরিফুল ইসলামকে সভাপতি ও এস এম সিরাজুল ইসলামকে সাধারণ সম্পাদক করে ২ সদস্যদের কমিটি করা হয়। পরবর্তী সময়ে জবি ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হয়। বর্তমানে দুই বছর এক মাস সময় অতিক্রম করছে ছাত্রলীগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ জেলা ইউনিট।
অথচ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় গঠনতন্ত্রে উল্লেখ আছে- ‘জেলা শাখার কার্যক্রম এক বছর। কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর জেলা শাখাকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নবনিযুক্ত কর্মকর্তাদের হাতে দায়িত্বভার বুঝিয়ে দিতে হবে। বিশেষ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের অনুমোদনক্রমে ৯০ দিন সময় বৃদ্ধি করা যাবে। এই সময়ের মধ্যে সম্মেলন না হলে জেলা কমিটি বিলুপ্ত বলে গণ্য হবে।’
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘জবি ছাত্রলীগে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি না হওয়ার আগ পর্যন্ত বর্তমান কমিটি কার্যক্রম চালিয়ে যাবে।’