‘৫ জানুয়ারির পর আন্দোলন গুটানো উচিত হয়নি’
৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর সরকারবিরোধী আন্দোলন গুটিয়ে নেওয়া সঠিক হয়নি বলে মনে করছে ২০ দলীয় জোটের শরিকরা। জোটের প্রধান ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ শরিক দলগুলো মনে করছে, সরকারবিরোধী আন্দোলন ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যাওয়াই উচিত ছিল। আন্দোলন অব্যাহত রাখলে আওয়ামী লীগ ওই মাসের মধ্যেই ২০ দলের দাবি মেনে নিয়ে আরেকটি নির্বাচন দিতে বাধ্য হত।
আগামী ১৬ ডিসেম্বরের পর ঐক্যবদ্ধভাবে অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দিয়ে মাঠে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলে আগামী জানুয়ারির মধ্যেই নির্বাচন দিতে সরকারকে বাধ্য করার বিষয়টি আমলে নিয়েছে ২০ দলীয় জোট। ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে শনিবার রাতে এ সব নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা দ্য রিপোর্টকে এ সব তথ্য নিশ্চিত করেন। রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বেগম খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ২০ দলীয় জোটের বৈঠকে জোটের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে মুক্ত আলোচনায় জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য ডা. রেদোয়ান উল্লাহ শাহেদী বলেন, ‘লংটার্ম আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া কঠিন। লংটার্মে সরকার পতনের আন্দোলন হয় না। অল্প সময়েই সরকার পতন আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে অবরোধের মতো কর্মসূচি দিলেই ভাল। কারণ, আমরা অবরোধ ডাকলে তো সরকার নিজেই সারাদেশে অবরোধ করে ফেলে। আর এ ধরনের কর্মসূচি ধারাবাহিকভাবে দিলে সরকার দুর্বল হয়ে পড়ে।’
তিনি বলেন, ‘গত ডিসেম্বরে (২০১৩) আমরা আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়েছিলাম। ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ জোর করে ভোটারবিহীন নির্বাচন করেছে। আমাদের উচিত ছিল এই আন্দোলনকে চালিয়ে যাওয়া। ৫ জানুয়ারির পর আন্দোলন গুটিয়ে নেওয়া ঠিক হয়নি।’
এ সময় খালেদা জিয়া বলেন, ‘হ্যাঁ তা সঠিক হয়নি। কিন্তু আমার দলের কেউ বা আাপনারাও তো আমাকে এ বিষয়ে কোনো পরামর্শ দেননি।’
লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান তখন বলেন, ‘ম্যাডাম এ বিষয়ে আপনাকে অবহিত করতে আমি শিমুল বিশ্বাসকে চারবার ফোন করেছিলাম। কিন্তু তিনি ধরেননি।’
খালেদা জিয়া তখন বলেন, ‘শিমুল বিশ্বাস তো তখন জেলে। আপনি তারে ফোন দিলেন কীভাবে?’ এ সময় বৈঠকে উপস্থিত সবাই হেসে ওঠেন।
খেলাফত মজলিশের আমীর অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ ইসাহাক বলেন, ‘আমার বয়স হয়েছে। যে কোনো সময় মৃত্যু হতে পারে। তাই জীবন নিয়ে আমি ভাবি না। স্বৈরাচারী সরকার হটানোর আন্দোলনে আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত আছি।’
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘২০ দলের বাইরেও অনেক দল আছে। তারা জোটে আসুক-না আসুক। কমপক্ষে যাতে তারা আমাদের সাথে যুগপৎ আন্দোলনে আসে সে ব্যাপারে চিন্তা করা উচিত। আর ডিসেম্বর হল আমাদের বিজয়ের মাস। এ মাসটিকে আওয়ামী লীগ তাদের একক হকদার হিসেবে দাবি করে। আমাদের উচিত বিজয়ের মাসে সঠিকভাবে গুরুত্ব সহকারে নানা কর্মসূচি পালন করা। আওয়ামী লীগতে বুঝিয়ে দিতে হবে মুক্তিযুদ্ধ শুধু তাদের একক সম্পদ নয়। শহীদ জিয়াসহ আমরাও জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছি।’
জেনারেল ইবরাহিমের কথা বলা শেষ হওয়ার পরপরই আবারও কথা বলেন মাওলানা ইসাহাক। তিনি খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘কারা আন্দোলনে আসল আর কারা আসল না এটা বিষয় না। কারণ স্রোতের বিপরীতে কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। তারা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।’
এ সময় তার কথা শেষ হতে না হতেই খালেদা জিয়া মুচকি হেসে বলেন, ‘কিন্তু জামায়াতের সর্বশেষ দু’টি হরতালে নেতাকর্মীদের মাঠে দেখা যায়নি।’
তাৎক্ষণিক বক্তব্যে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থ হাসতে হাসতে বলেন, ‘শাহেদী ভাই (জামায়াত নেতা) আপনারা কি সরকারের সঙ্গে কথা বলেই হরতাল দিয়েছিলেন?’ এ সময় বৈঠকজুড়ে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়।
বৈঠকে জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান বলেন, ‘ম্যাডাম, আসলে দিনক্ষণ ঠিক করে আন্দোলন হয় না। একটি ঘটনাই স্ফুলিঙ্গের মতো আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে পারে।’
এ সময় তিনি ১৯৬৯ সালের গণঅভুত্থানের উদাহরণ টেনে বলেন, ‘এক আসাদের লাশই আইয়ুব শাহীর পতন ঘটিয়েছিল। ডা. মিলনের লাশই স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ঘণ্টা বাজিয়েছিল।’
খালেদা জিয়ার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনি দীর্ঘ নয় বছর স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছিলেন। সুতরাং আন্দোলনের কৌশল আপনাকেই প্রণয়ন করতে হবে। আন্দোলনের কৌশল প্রণয়ন করে আমাদের হুকুম দিতে হবে।’
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জায়গায় ২০ দলীয় জোটের জনসভায় লাখ লাখ লোকের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে প্রধান বলেন, ‘আপনার জনসভায় লাখ লাখ লোকের উপস্থিতি প্রমাণ করে জনগণ সরকার পতনে উদগ্রীব।’
এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ খালেদা জিয়াকে বলেন, ‘আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আপনি রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছিলেন। আপনার চাইতে আন্দোলন আর কেউ ভাল বুঝে না। আন্দোলনের জন্য জনগণ তৈরি আছে। তারা এখন আপনার ডাকের অপেক্ষায় রয়েছে।’
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থ সরকারের গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির উদ্যোগ প্রসঙ্গে বলেন, ‘রেন্টাল-কুইক রেন্টালের নামে সরকারঘনিষ্ট ৭-৮ জন ব্যবসায়ী সমগ্র জাতিকে লুট করছে। এ বিষয়টি জনগণের সামনে তুলে ধরা উচিত।’
প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয় সম্পর্কেও কথা বলেন পার্থ। তিনি বলেন, ‘জয়কে প্রধানমন্ত্রীর অবৈতনিক তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা করে দুই দিন আগে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এর অনেক আগে থেকেই তো তিনি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা। তাহলে এতদিন তিনি কিসের ভিত্তিতে উপদেষ্টা ছিলেন?’
সজিব ওয়াজেদ জয়ের মাসিক সম্মানি ২ লাখ ডলার- সাবেক মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে আন্দালিভ রহমান পার্থ বলেন, ‘সাংবিধানিক পদের কোনো ব্যক্তি ডলারে বেতন নিতে পারেন না। এটি সংবিধান পরিপন্থী।’ বিষয়টি জনগণের সামনে তুলে দরতে পরামর্শ দেন তিনি।
ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামী খালেদা জিয়াকে বলেন, ‘আপনি যদি অবরোধের মতো কর্মসূচি দেন, তাহলে সরকার নিজেই সারাদেশে অবরোধ পালন করবে। আমাদের এই অবরোধ কন্টিনিউ (ধারাবাহিকভাবে) করতে হবে। তাহলে সরকারের পতন অনিবার্য।’
বৈঠকে উপস্থিত জোট নেতারা সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণের বিষয়টি বেগম খালেদা জিয়ার উপরেই ছেড়ে দেন।
সর্বশেষ বক্তৃতায় খালেদা জিয়া বলেন, ‘আগামী ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস। এ ছাড়া পরীক্ষা চলছে। এর আগে তো অবরোধ বা এ ধরনের কোনো কর্মসূচি দেওয়া ঠিক হবে না।’
তিনি জোট নেতাদের বলেন, ‘এবার আমি নিজে আন্দোলনের মাঠে নামব। আর আপনারা সবাই আমার সঙ্গে থাকবেন।’ এ সময় সবাই তার পাশে থাকার ব্যাপারে সাড়া দেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, ১৬ ডিসেম্বরের পর সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু এবং জানুয়ারির মধ্যে আওয়ামী লীগকে দাবি মেনে নিতে বাধ্য করিয়ে নির্বাচন আদায় করতে চায় ২০ দলীয় জোট।
বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় পার্টির (জাফর) টিআইএম ফজলে রাব্বি ও মোস্তফা জামাল হায়দার, বাংলাদেশ মুসলিম লীগের সভাপতি এইচ এম কামরুজ্জামান খান, বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) চেয়ারম্যান খন্দকার গোলাম মোর্তুজা, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, ইসলামিক পার্টির চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট আব্দুল মবিন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মহিউদ্দিন ইকরাম, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ভাসানী) চেয়ারম্যান আজহারুল ইসলাম, ডেমোক্রেটিক পার্টির (ডিএল) মহাসচিব সাইফুদ্দিন আহমেদ মনি, পিপলস লিগের সভাপতি গরীবে নেওয়াজ, সাম্যবাদী দলের সাঈদ আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।