ঐতিহ্যবাহী ওয়ানগালায় মেতেছে শেরপুরের গারোরা
বাংলাদেশের আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠীর গারোদের নিজস্ব সাংস্কৃতি ও কৃষ্টির অন্যতম উৎসব হলো নবান্ন বা ওয়ানগালা।
রোববার সকাল থেকে ওয়ানগালা উৎসবে মেতে উঠেছে শেরপুরের সীমান্তবর্তী ও দেশের ঐতিহ্যবাহী গারো পাহাড় এলাকার গারোরা।
ওয়ানগালা উৎসব আয়োজক কমিটি সূত্রে জানা গেছে, এক সময় গারো পাহাড়ি এলাকায় জুমচাষ হতো এবং বছরে মাত্র একটি ফসল হতো। তখন ওই জুম বা ধান ঘরে উঠানোর সময় গারোদের শস্যদেবতা ‘মিসি সালজং’কে উৎসর্গ করে এ উৎসবের আয়োজন করা হতো।
এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, গারোদের ওই শস্যদেবতা এক সময় পাহাড়ি এলাকার গারোদের হাতে কিছু শস্য দিয়ে বলেছিল, ‘তোমরা এটা রোপন করো তাতে তোমাদের আহারের সংস্থান হবে এবং তোমরা যে শস্য পাবে তা থেকে সামান্য কিছু শস্য আমার নামে উৎসর্গ করবে।’ এরপর থেকেই গারোরা তাদের শস্যদেবতাকে এই ফসল উৎসর্গ করে আসছে।
কিন্তু গারোরা খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর তাদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক প্রথাটি এখন ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে একত্রে করে পালন করা হয়। অর্থাৎ এক সময় তারা তাদের শস্যদেবতা মিসি সালজংকে উৎসর্গ করে ওয়ানগালা পালন করলেও এখন তারা নতুন ফসল কেটে যিশু খ্রিস্ট বা ঈশ্বরকে উৎসর্গ করে ওয়ানগালা পালন করেন। এ সময় সামাজিক নানা আয়োজনসহ ধর্মীয় নানা আচার-অনুষ্ঠানাদিও পালন করা হয়।
শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার সীমান্তবর্তী মরিয়মনগর খ্রিস্টান ধর্মপল্লীর নিয়ন্ত্রণে জেলার সদর উপজেলাসহ শ্রীবরর্দী, ঝিনাইগাতী এবং জামালপুর জেলার বক্সীগঞ্জ উপজেলার গারো সমাজের ৪৭টি গ্রাম রয়েছে। ওইসব গ্রামের প্রায় ২২ হাজার খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী গারো সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস। মরিয়মনগর ধর্মপল্লীতে এ ওয়ানগালা উৎসবে খ্রিস্টান গারোরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে এসে মাতোয়ারা হয়ে উঠে।
এছাড়া এবার মরিয়ম নগরের এই ওয়ানগালা উৎসবটি ২৯ বছরে পা দিয়েছে। ১৯৮৫ সাল থেকে এখানে ওয়ানগালা উৎসব পালন করা হচ্ছে। ফলে গারোদের মাঝে উৎসবের আমেজটা ছিল অন্যবারের চেয়ে অনেক বেশি। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে অসংখ্য খ্রিস্ট ভক্ত এবং গারাগানজিং, কতচু, রুগা, মমিন, বাবিল, দোয়াল, মাতচি, মিগাম, চিবক, আচদং, মাতাবেং ও আরেং নামে ১২টি গোত্রের গারো সম্প্রদায়ের লোকজন উপস্থিত ছিলেন।
স্থানীয় মরিয়মনগর হাইস্কুল মাঠে রোববার সকাল সাড়ে ৯টায় তক্কাদানের মাধ্যমে শুরু করা হয় আনুষ্ঠানিক ওয়ানগালা উৎসব। এরপর খ্রিস্ট পর্ব, মিশা, ফসল উৎসর্গ, ধর্মীয় আলোচনা ও গারোদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক এবং বেলা ২টার দিকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ‘নক গাদ্দা’ বা ফসল উৎসর্গ ও প্রীতি ভোজের আয়োজন করা হয়। এছাড়া বিকেলে মরিয়মনগর হাইস্কুল মাঠে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় এবং রাতে নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি করা গারো ভাষায় ‘চু’ (মদ) পান করে দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মালিকদের কাছ থেকে দান আদায় করার মধ্যদিয়ে ওয়ানগালার আনুষ্ঠিকতা শেষ করা হবে।
অপরদিকে, ওয়ানগালা উৎসব উপলক্ষ্যে মিশনের পাশে বসেছিল জমজমাট মেলা। মেলায় গারোদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকসহ শিশুদের নানা রকমের খেলনা বিক্রি করা হয়। ফলে এখানে গারো শিশু ও যুবক-যুবতীরা বিভিন্ন পসরার দোকানে তাদের পছন্দের জিনিস কিনতে ভিড় জমায়।
ওয়ানগালা উৎসবে জেলাসহ জেলার বাইরে থেকে আসা গারো এবং তাদের আত্মীয়রা একে অপরের সঙ্গে দীর্ঘদিন পর দেখা সাক্ষাত হওয়ায় তাদের মাঝে অনেকটা বড় দিনের উৎসবের মতো আনন্দ উপভোগ করেন।