প্রধানমন্ত্রীকে গুলিবিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতার খোলা চিঠি ‘একবার বলুন, আমরা ছাত্রলীগের কর্মী, বঙ্গবন্ধুর সৈনিক’
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত সুমন চন্দ্র দাসসহ আহতরা ছাত্রলীগ কর্মী দাবি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খোলা চিঠি দিয়েছেন গুলিবিদ্ধ হুসাইন মোহাম্মদ সাগর।
সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্রলীগের সভাপতি হুসাইন মোহাম্মদ সাগর ওই সংঘর্ষে পেটে গুলিবিদ্ধ হন। বর্তমানে তিনি পুলিশের নজরদারিতে সিলেট ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সোমবার যোগাযোগ করা হলে তিনি দ্য রিপোর্টকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি লেখার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
তিনি ওই সংঘর্ষ এবং সংঘর্ষে ছাত্রলীগ কর্মী নিহতের ঘটনায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেন। রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা খোলা চিঠিতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন করেন, ‘বাঁচব কী মরব জানি না। বাঁচলে পুলিশি নির্যাতন কবে বন্ধ হবে তাও জানি না। কিন্তু আপনার (প্রধানমন্ত্রী) মুখ থেকে শুনতে চাই, কমিটি গঠনের দীর্ঘসূত্রতায় যে লাখ লাখ কর্মী কমিটিতে স্থান পায় না, তারাও ছাত্রলীগের কর্মী। আমার বন্ধু মারা গেছে, আমরা গুলিবিদ্ধ হয়েছি, পুলিশ নির্যাতন চালাচ্ছে, তাতে কষ্ট নেই। আপনি (প্রধানমন্ত্রী) শুধু সোহাগ ভাইকে (কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি) একবার বলুন, আমরা ছাত্রলীগের কর্মী, বঙ্গবন্ধুর সৈনিক। আমাদের সেই অধিকারটুকু যাতে উনি কেড়ে না নেন।’
২০ নভেম্বর (বৃহস্পতিবার) শাবিপ্রবিতে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধে সুমন চন্দ্র দাস নিহত এবং অন্তত পাঁচজন আহত হন। ওই ঘটনায় শুক্রবার সকালে সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ বলেন, ‘শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) বৃহস্পতিবার দু’পক্ষের মধ্যে যে সংঘর্ষ হয়েছে তাতে ছাত্রলীগ জড়িত নয়। ছাত্রলীগের কেউ এ সংঘর্ষে জড়িত ছিল না। সুমন দাস নামের যে ছাত্র মারা গেছে সেও ছাত্রলীগের কেউ নয়। কিছু গণমাধ্যম সংঘর্ষের ঘটনার সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ছাত্রলীগকে জড়ানোর চেষ্টা করছে।’
খবর বাংলা২৪.কমের পাঠকের জন্য হুসাইন মোহাম্মদ সাগরের লেখা খোলা চিঠিটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
আমি হুসাইন মোহাম্মদ সাগর। সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, মাস্টার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র। বংশ পরাক্রমায় আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আমি যখন বুঝতে শিখিনি তখনই বাবা-ভাইদের সঙ্গে গ্রামের মেঠো পথ ধরে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে ছোট বাজারে যাই। আমার বড় ভাই বর্তমান ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের প্রস্তাবিত কমিটির সভাপতি।
বিশ্ববিদ্যালয়টি মূলত শিবিরের আস্তানা হিসেবে সিলেটে পরিচিত ছিল। যার প্রতিটি সেমিস্টারে ছিল শিবিরের সাংগঠনিক কমিটি। আজ ক্যাম্পাসটি শিবিরমুক্ত। আমি, নিহত সুমন চন্দ্র দাস ও ছাত্রলীগের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা ক্যাম্পাসটি শিবিরমুক্ত করি, যা তখন বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়ায় এসেছে। সিলেটের আওয়ামী রাজনীতির সিনিয়র নেতৃবৃন্দের কাছে আমাদের আলাদা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।
মাননীয় নেত্রী, গত কয়েক দিন পূর্বে শাবিপ্রবিতে হামলার ঘটনা সম্পর্কে আপনি কিছুটা অবগত আছেন। সেদিন সকাল ৯টার দিকে আমার কাছে খবর আসে, শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি অঞ্জন দাসের ওপর হামলা হয়েছে। নিজের এক সহকর্মী ভাইয়ের ওপর হামলার কথা শুনে আমি, সুমন চন্দ্র দাসসহ ১০/১৫ জন তাৎক্ষণিক ছুটে যাই। গিয়ে সেখানে হতভম্ব হই। সেখানে আগে থেকে ওতপেতে থাকা সন্ত্রাসীরা বৃষ্টির মতো গুলি চালায়। ওদের গুলি আমার সামনে থাকা সুমন চন্দ্র দাসের গায়ে লাগে। সে তাৎক্ষণিক মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তাকে আনতে গিয়ে একটি গুলি আমার পেটে বিদ্ধ হয়। আরও কয়েক বন্ধু গুলিবিদ্ধ হয়। সুমন চন্দ্র দাসকে হাসপাতালে আনার পরই মারা যায়। আমিসহ আরও কয়েক বন্ধু, শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি অঞ্জন রায় আজও গুলিবিদ্ধ হয়ে এখনও হাসপাতালের বেডে শুয়ে নিহত সুমনের যাত্রী হওয়ার প্রহর গুনছি। সুমন যেন আমাদেরই ডাকছে। বলছে, বাড়ি থেকে মায়ের হাতের নাড়ু এনেছি। আমি কি একা খাব, তোরা খাবি না? এ অবস্থায় পুলিশ আমাদের গ্রেফতার করে নজরবন্দী করে রাখে।
মাননীয় নেত্রী, গুলিবিদ্ধ হলাম আমরা। এক সহযোদ্ধাকে সারাজীবনের জন্য হারালাম। আমরা আবার গ্রেফতার। তাতেও দুঃখ নেই। এর চেয়ে বড় দুঃখ হচ্ছে, আমাদের কেন্দ্রীয় সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ ভাই সত্যি ঘটনা না জেনে (যা পত্রপত্রিকায়ও এসেছে) তথ্য বিভ্রাটে প্ররোচিত হয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘নিহত সুমন চন্দ্র দাস ছাত্রলীগের কেউ নয়। তখন আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না।’
প্রাণপ্রিয় নেত্রী, সুমন ছিল এক মুক্তিযোদ্ধা বাবার সন্তান। তিন বোনের একমাত্র আদরের ভাই। সে আমাদের প্রায়ই বলত, সে ছাত্রলীগের রাজনীতি করে তার মুক্তিযোদ্ধা বাবার ইচ্ছা ও অনুপ্রেরণায়। সে জন্য সব সময় মিছিলের অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিত। তার মৃত্যু হয়েছে সামনে থাকার জন্যই।
মাননীয় নেত্রী, আপনার কাছে প্রশ্ন, ছাত্রলীগের কমিটিতে কয়জন কর্মীর স্থান আছে? প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হাজার হাজার, লাখো লাখো কর্মী রয়েছে। আপনি জানেন, অধিকাংশ কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে ১০ বছর পর্যন্ত পার হয়ে যায়। তাই সুমন চন্দ্র দাসের মতো ত্যাগী কর্মীরা নেতা হতে পারে না। তারা কর্মী হয়েই বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখে। আর সুমন ও আমাদের মতো কর্মী দিয়ে সোহাগ ভাইরা হন নেতা। এ জন্য সুমন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়ে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ হৃদয়ে ধারণ করে, সন্ত্রাসীদের গুলিতে জীবন দিয়েও ছাত্রলীগের কর্মী হতে পারল না। আমার মনে হয় তার নামের সঙ্গে দাস না থাকলে হয়ত তাকে শিবির বলে চালিয়ে দেওয়া হতো।
নেত্রী, হাসপাতালের বেডে শুয়ে আপনার কাছে আকুল আবেদন, বাঁচব কী মরব জানি না। বাঁচলে পুলিশি নির্যাতন কবে বন্ধ হবে তাও জানি না। কিন্তু আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই, কমিটি গঠনের দীর্ঘসূত্রতায় যে লাখ লাখ কর্মী কমিটিতে স্থান পায় না, তারাও ছাত্রলীগের কর্মী। আমার বন্ধু মারা গেছে, আমরা গুলিবিদ্ধ হয়েছি, পুলিশ নির্যাতন চালাচ্ছে, তাতে কষ্ট নেই। আপনি শুধু সোহাগ ভাইকে একবার বলুন, আমরা ছাত্রলীগের কর্মী, বঙ্গবন্ধুর সৈনিক। আমাদের সেই অধিকারটুকু যাতে উনি কেড়ে না নেন।
বিনীত
হুসাইন মোহাম্মদ সাগর
ছাত্রলীগের এক কর্মী।