বগুড়ায় সাড়ে ৪ বছরে ৩৪ নেতাকর্মী খুন আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজিতে ব্যস্ত আ.লীগ
গত সাড়ে চার বছরে বগুড়ায় খুন হয়েছেন আওয়ামী লীগের ৩৪ জন নেতাকর্মী। আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি নিয়ে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ বিরোধে আওয়ামী লীগের এ সব নেতাকর্মী খুন হয়েছেন বলে দাবি পুলিশ প্রশাসনের।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে রয়েছে শহর ও শহরতলী এলাকায় সরকারি জমি দখলের অভিযোগ। আর এ সব কারণে বাড়ছে দলীয় কোন্দল, নেতাকর্মীরা জড়িয়ে পড়ছেন গ্রুপিংয়ে।
সর্বশেষ, ৩০ অক্টোবর বগুড়া সদরের শাখারিয়া ইউনিয়নের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের দু’গ্রুপের মধ্যে বিরোধের জের ধরে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেনকে (৫৫) গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে পিস্তলের গুলির ২২টি খোসা উদ্ধার করেছে। পুলিশ রাতেই ছাত্রলীগ সরকারি আজিজুল হক কলেজ শাখার সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল হুদা উজ্জ্বল ও তার সঙ্গী পলাশকে গ্রেফতার করে।
গত ২৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে খুন হয়েছে জেলা বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের আহ্বায়ক শিমুল হক রেহান। কমিটি গঠন নিয়ে বিরোধের জের ধরে তাকে খুন করা হয়। শহর শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক সবুজ সওদাগরের বিরোধ চলছিল। এর জের ধরে সবুজ সওদাগর সমর্থকরা রেহানের বুকে ছুরিকাঘাত করলে রেহান মারা যায়। পুলিশ এ ঘটনায় সবুজ সওদাগরসহ চারজনকে আটক করে।
২০১৪ সালের ২৬ মে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপে বিরোধের জের ধরে উপজেলার গণ্ডগ্রাম মিয়া পাড়ায় এক যুবলীগ নেতা ও আরেক যুবলীগ কর্মীকে একই স্থানে জবাই করে প্রতিপক্ষরা। জানা যায়, জমি দখলের টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে চাচা-ভাতিজা মজনু মিয়া ও নাহিদকে খুন করা হয়।
গত বছরের ডিসেম্বরে জনসম্মুখে খুন হন শহর স্বেচ্ছাসেবকলীগের প্রভাবশালী নেতা খায়রুল আনাম রেক্কাত। একই মাসে খুন হন যুবলীগের কর্মী শামিম হোসেন ওরফে বুশ (২৫)।
তবে বেশির ভাগ খুনি এবং তাদের গডফাদাররা আড়ালে থেকে গেছেন। আবার অনেকে জামিন নিয়ে প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করছেন। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, মাদক ও বালু ব্যবসা নিয়ে বিরোধের জেরে এ সব খুনের ঘটনা ঘটে। এ সব ঘটনায় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও প্রভাবশালী আসামিরা রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
পুলিশের দেওয়া তথ্যানুসারে, ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে চলতি বছরে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার বছরে খুনের তালিকায় রয়েছেন আওয়ামী লীগের ১২ জন, যুবলীগের ১২, স্বেচ্ছাসেবক লীগের তিন, কৃষক লীগের দুই, ছাত্রলীগের তিন এবং শ্রমিক লীগের ২ জন নেতাকর্মী।
এর মধ্যে ১৭ নেতাকর্মী খুন হয়েছেন বগুড়া শহর ও শহরতলী এলাকায়। অঞ্চলভিত্তিক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খুনগুলো সংঘটিত হয়।
আলোচিতদের মধ্যে রয়েছে, শহর আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক সুজানুর রহমান সুজন, নন্দীগ্রাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ইউছুফ আলী, নন্দীগ্রাম পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান, শহর স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আশীষ কুমার রায়, সরকারি শাহ সুলতান কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী নিরঞ্জন চক্রবর্তী, যুবলীগের নেতা আমিনুর রহমান ওরফে শাহীন, শ্রমিক লীগের সাবগ্রাম বন্দর শাখার সভাপতি হাসানুজ্জামান ওরফে নাসিম এবং সাধারণ সম্পাদক ইসরাইল হোসেন, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন ওরফে জুয়েল, যুবলীগ কর্মী রোকনুজ্জামান ওরফে রিপন, সদরের রাজাপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি শফিকুল ইসলাম, যুবলীগের গোয়ালগাড়ী আঞ্চলিক কমিটির সদস্য নান্না মিয়া, যুবলীগের নাটাইপাড়া আঞ্চলিক কমিটির সদস্য সবুজ মিয়া, ৬ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের কর্মী সুমন চৌধুরী এবং কৃষক লীগের ২০ নম্বর ওয়ার্ড কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ আহমেদ, গাবতলী পৌর যুবলীগের সভাপতি তারিকুল ইসলাম, ধুনট উপজেলার আওয়ামী লীগ কর্মী লাল মিয়া ও তার ছোট ভাই নয়া মিয়া হত্যাকাণ্ড।
হত্যাকাণ্ড কেবল নয় দলীয় লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার। চলতি বছরের মে মাসে বগুড়া সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি আবু সুফিয়ান সফিক ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট রাব্বানীর মধ্যে দলীয় কোন্দলের জেরে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে রাব্বানীসহ তার কয়েকজন সমর্থক গুরুতর আহত হয়ে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।
এই ঘটনায় এ্যাডভোকেট রাব্বানী থানায় মামলা করতে যান। কিন্তু জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির নির্দেশে থানায় মামলা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ রাব্বানীর। পরবর্তী সময়ে আদালতে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সফিককে প্রধান করে মামলা করেন ভুক্তভোগী।
মামলার আসামি সুফিয়ান সফিক আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলে আদালত জামিন না মঞ্জুর করে আসামিকে জেলহাজতে পাঠান। দুই সপ্তাহ পর জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসেন উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবু সুফিয়ান সফিক।
এ ছাড়া অবৈধভাবে সরকারি জমি দখলের অভিযোগ আছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। শহরের চকলোকমান লতিফপুর কলোনির এসওএস শিশু পল্লীর পেছনে মুক্তিযোদ্ধা আব্বাস আলী আকন্দের ৬৪ শতাংশ জমি দখল করে সেখানে পোল্টিফার্ম করেছেন বগুড়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি আসাদুজ্জামান দুলু। এই জমিদখলকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিরোধে চাচা-ভাতিজা খুনের ঘটনা ঘটে। হত্যাকাণ্ডে দায়ের করা মামলায় প্রধান আসামি ছিলেন আসাদুজ্জামান দুলু। পরে চার্জশিট থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হয়।
বগুড়া রেলস্টেশন এলাকায় রেলওয়ের দুটি পুকুর ভরাট করে নিয়েছেন শীর্ষস্থানীয় মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা। শহরের তিনমাথা এলাকায় বাফার গুদামে মালামাল নিয়ে আসার জন্য নির্মাণ করা বিকল্প রেললাইন দখল করে সেখানে পাকা ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। সংকটকালীন এ রেললাইন ব্যবহার করতে চাইলেও কর্তৃপক্ষ তা করতে পারবে না।
এই দখল প্রক্রিয়ায় শহর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আব্দুল মান্নান, বগুড়া মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক শামছুদ্দিন শেখ হেলাল ও যুবলীগ নেতা আব্দুল মতীনসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী যুক্ত রয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘এই দুষ্টুচক্রের কার্যকালাপে মুখ দেখানো কঠিন হয়ে পড়েছে। দলের নেতাকর্মীরা ভাল কাজের পরিবর্তে এমন সব কার্যকলাপ করেছে তাতে সাধারণ মানুষের মন বিষিয়ে উঠছে।’
রেলওয়ের জায়গা দখল প্রসঙ্গে শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল মান্নান বলেন, ‘মৎস্য চাষের জন্য রেলওয়ের কাছ থেকে পুকুর দুটি লিজ নেওয়া হয়েছে। পুকুর ভরাট করে মার্কেট নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে। মার্কেট নির্মাণ করলে রেলওয়ে বিভাগ প্রতিবছর এখান থেকে ১২ লাখ টাকা রাজস্ব পাবে।’
বগুড়া মোটর শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক শামছুদ্দিন শেখ হেলাল বলেন, ‘বগুড়া শহরের একাধিক পুকুর ভরাট করে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এ সব ক্ষেত্রে পরিবেশ নষ্ট না হলে রেলের পুকুর ভরাট করলে পরিবেশ নষ্ট হওয়ার কথা উঠছে কেন?’
রেলওয়ে লালমনিরহাটের বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা আশিষ কুমার চন্দ্র জানান, সরকারি জমি দখল করায় ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা মান্নান, হেলাল ও মতিনের বিরুদ্ধে বগুড়া সদর থানায় মামলা হয়েছে। তারপরও ক্ষমতার জোরে তারা ভরাট কাজ চালু রেখেছেন।
পুলিশ সুপার মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী খুনের যে সব ঘটনা ঘটেছে, তার নেপথ্যে রয়েছে আধিপত্য বিস্তার, জমিদখল, টেণ্ডারবাজির টাকা ভাগবাটোয়ারা এবং অবৈধ বালু ব্যবসা নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধ। রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন থেকে কোনো কোনো নেতার অবৈধ সম্পদ অর্জনের ঝোঁক এবং অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায় খুনের ঘটনাগুলো ঘটছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, ‘বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মমতাজ উদ্দীন দীর্ঘদিন ধরে কমিটির সভাপতি রয়েছেন। নেতৃত্বে তিনি নতুন চমক দেখাতে পারছেন না ফলে কমিটিতে বর্তমানে চাঙ্গাভাব নেই। কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও কাউন্সিল না হওয়ায় পদপ্রত্যাশীদের মনে বিরাজ করছে হতাশা, সৃষ্টি হচ্ছে না নতুন নেতৃত্ব।’
বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মমতাজ উদ্দীন বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহাসিক দল, সে কারণে দলের নেতৃত্বে প্রতিযোগিতা রয়েছে। তা ছাড়া কাঙ্ক্ষিত পদ না পেয়ে কেউ কেউ মনক্ষুণ্ন হতে পারেন। এটাকে দলীয় কোন্দল বলা যাবে না। জেলা কমিটির পুনর্বিন্যাস প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আশা করি খুব শিগগিরই কমিটিতে নতুন নেতৃত্ব আসবে।’
দলীয় নেতাকর্মী খুনের ঘটনায় তিনি বলেন, ‘মহাজোট সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে একের পর এক হত্যা করেছে সরকারবিরোধীরা ও সন্ত্রাসীরা। দলীয় কোন্দল কিংবা ভাগবাটোয়ারা নিয়ে আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মী মারা যায়নি।’
সরকারি জমি দখলের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে অন্যকেউ জমিদখল করছে।’