শেরপুরের সূর্য্যদী গণহত্যা দিবস পালিত
দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর। মুক্তিযুদ্ধের এদিনে শেরপুরের সূর্য্যদী গ্রাম ও আশপাশের এলাকা ভেসেছিল রক্তের বন্যায়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এ দেশীয় দোসর আলবদর, রাজাকারদের মাধ্যমে খবর পেয়ে হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধা ও আশ্রয়দাতা গ্রামবাসীকে শায়েস্তা করতে ছুটে যায় সেই গ্রামে। বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন এক মুক্তিযোদ্ধাসহ ৩৯ জন নিরীহ গ্রামবাসী। পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল প্রায় ৩০০ ঘরবাড়ি।
বছর ঘুরে দিনটি এলেই স্বজন হারানোর বেদনায় ভারাক্রান্ত হন গ্রামবাসীরা। সেদিন সকাল ৭ টা। গ্রামবাসীরা কেউ বাড়ির উঠানে শীতের মিঠে রোদ পোহাচ্ছেন, আবার কেউবা কৃষিকাজ নিয়ে মাঠে ব্যস্ত। এমন সময় জিপ আর ট্রাক বোঝাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রামটিতে হামলে পড়ে। লোকজন কিছু বুঝে ওঠার আগেই হানাদার বাহিনী ছুড়তে থাকে এলোপাতাড়ি গুলি। একই সময়ে গান পাউডার ছিটিয়ে দিয়ে এ গ্রামের দেওয়ানবাড়ি, কিরসাবাড়ি ও বড়বাড়ির প্রতিটি ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। আর গ্রামের যুবক-কিশোর যাদের পায় তাদের ধরে এনে ব্রাশফায়ারে হত্যা করার জন্য দাঁড় করায় স্থানীয় ধানক্ষেতের মধ্যে।
রক্তের নেশায় উন্মুখ হিংস্র হায়েনাদের হাত থেকে তাদের রক্ষা করতে এ সময় নিজেদের নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও ওইদিন আত্মগোপন করে থাকা এ গ্রামেরই বাসিন্দা ৬ বীর মুক্তিযোদ্ধা গিয়াস কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব আলী, আবদুল খালেক, ফজলুর রহমান, হাবীবুর রহমান, মমতাজ উদ্দিন ও আবুল হোসেন সামনে এগিয়ে আসেন। মাত্র ৪৫ রাউন্ড গুলি, এসএমজি আর কয়েকটি গ্রেনেড নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েন হানাদারদের ওপর।
একটু পরেই তাদের সঙ্গে যোগ দেন অন্য গ্রামে আত্মগোপন করে থাকা কোম্পানি কমান্ডার গিয়াস উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের আরো দুটি দল। সম্মিলিত আক্রমণের মুখে হানাদাররা দ্রুত পিছু হটে যায়। এ যুদ্ধেই শহীদ হন খুনুয়া চরপাড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আফসার আলী। এদিন আরো শহীদ হন আইজ উদ্দিনসহ ৩৯ জন নিরীহ গ্রামবাসী। শহীদ আফসারের মা এখনও ছেলের কবরের পাশে ঘুরে বেড়ান এবং বলেন, ৪৩ বছরেও কেউ তাদের খোঁজ নেয়নি।
সূর্য্যদী গণহত্যার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আফসার আলীর স্মরণে তার গ্রামের বাড়ী খুনুয়াতে আফসারের বাল্য বন্ধু বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ হেফজুল বারী উদ্যোগে একটি স্মৃতি সৌধ ও কবরটি পাকা করা হলেও সূর্য্যদী গ্রামের শহীদ ৩৮ জন গ্রামবাসীর কবরের কোন চিহ্ন নেই। এ নিয়ে শহীদদের আত্মিয়দের মধ্যে কিছুটা ক্ষোভও রয়েছে।এখনও দূঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে ওই গ্রামের বিধাবা মহিলারা। প্রতি বছর অনেকটা নিরবেই কেটে যায় সূর্য্যদী গণহত্যা দিবস।