অমৃতস্য পুত্রাঃ সৈয়দ আবুল মকসুদ
কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) অথবা বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) জাতীয় সম্মেলনে ভারতসহ কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিরা ঢাকায় এসেছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ নগরের ঐতিহাসিক স্থান দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমি তাঁদের নিয়ে ঘুরতে বের হই। গুলিস্তান মহানগর নাট্যমঞ্চ থেকে রওনা দিয়ে কার্জন হল, মেডিকেল কলেজ, জগন্নাথ হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ঢাকেশ্বরী মন্দির দেখিয়ে ভাবলাম তাঁদেরকে দেশের প্রাচীনতম কলেজটি দেখাই। নীলক্ষেত-নিউমার্কেটের চৌরাস্তা পেরিয়ে বলাকা সিনেমা হলের কাছে আসতেই দেখি সামনে লঙ্কাকাণ্ড। লোকজন দৌড়াচ্ছে পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে দিগ্বিদিক। শুনলাম কিছুক্ষণ আগে নির্মল আনন্দে গাড়িও ভাঙচুর হয়েছে। ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলছে। এক বিদেশি অতিথি জিগ্যেস করলেন, ব্যাপার কী? এরা কারা?
পরিস্থিতি দেখে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। বললাম, ব্যাপার কী তা আপনাদের না জানলেও চলবে। যাদের কারণে লোকে ছোটাছুটি করছে, তারা হলো অমৃতস্য পুত্রাঃ—অমৃতের পুত্র। এরা অজর, অমর। সরকার আসে, সরকার যায়—এরা আছে।
প্রায়ই টিভি সেট থেকে শোনা যায়, বাঙালি বীরের জাতি। টিভির পর্দাতেই আমরা দেখতে পাই বঙ্গসন্তানদের বীরত্বের বহিঃপ্রকাশ। মল্লযুদ্ধ অর্থাৎ খালি হাতে কিল-ঘুষি শুধু নয়, পায়ের সদ্ব্যবহার করতেও বাঙালির জুড়ি নেই। এই তো গত সপ্তার খবর। এক চ্যানেলের সংবাদপাঠিকা তরুণী জানালেন, দক্ষিণাঞ্চলের এক জেলায় এক বঙ্গসন্তানের পদাঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক সদস্য। সংবাদপাঠিকা বললেন, অণ্ডকোষে লাথি মারার পর আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নেওয়া হলে ডাক্তাররা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। সংবাদটির প্রতিবেদক লিখতে পারতেন, আঘাতটি লেগেছিল নিহত ব্যক্তির তলপেটে, কিন্তু তিনি খবরটিকে বস্তুনিষ্ঠ করতে তরুণীকে দিয়ে পাঠ করালেন, লাথি লেগেছে অণ্ডকোষে। আগে বাঙালি পদাঘাত করত শত্রুর পাছায়, এখন লক্ষ্যস্থল বদল করেছে।
বিশ্বায়নের যুগে অন্য দেশ থেকে খোন্তা, কুড়াল, কোদাল, লাঙলের ফাল, কাস্তে প্রভৃতি বাংলাদেশে চোরাচালান হয়ে আসায় আমাদের কর্মকারেরা বেকার হয়ে পড়েছিলেন। এখন তাঁদের অনেকে বেশ কামিয়ে নিচ্ছেন। পিস্তল, কাটারাইফেল ছিলই, বাজারে চাহিদা বেড়েছে এখন রামদা ও চাপাতির। একেকটি রামদা দৈর্ঘ্যে তিন ফুট। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্তপাতের পর শুক্রবার সিলেটে পুলিশ উদ্ধার করেছে ১৯টি দা ও রামদা। রাজশাহীতে কর্মকারের নাম খোদাই করা রামদা পাওয়া গেছে। বছর দুই আগে রাজশাহী ক্যাম্পাসে প্রদর্শিত হয় বিশ্বের দীর্ঘতম রামদা। গিনেস বুক বিষয়টি লক্ষ করেনি।
২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা গেছে, ‘গত ছয় বছরে ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যে বা অন্য সংগঠনের সঙ্গে অন্তত ৪৩২টি সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এতে নিহত হয়েছেন অন্তত ৫৪ জন। নিজ সংগঠনের ৩৯ জনের বাইরে বাকি ১৫ জনের মধ্যে দুটি শিশু এবং অন্যরা প্রতিপক্ষ সংগঠনের কর্মী বা সাধারণ মানুষ। এসব সংঘর্ষে আহত হয়েছেন দেড় হাজারের বেশি।’ [প্রথম আলো, ২২ নভেম্বর]
একই দিনে আমাদের সময় আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, ‘গত ১০ মাসে মোট ৫৫৮টি রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৩৭ জন নিহত এবং সাত হাজার ২০৪ জন আহত হন।’ এঁদের অধিকাংশই ‘ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের নৃশংস বলি’।
পরের দিনের যুগান্তর আসককে উদ্ধৃত করে এক প্রতিবেদনে জানায়, ‘…গত ছয় বছরে সুমনের মতো হত্যার শিকার হয়েছে ১৬৭ জন এবং আহত হয়েছে ১৩ হাজার ৩৪৫ জন। আর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ১০৮০টি।’ এসব ঘটনার সবই শিক্ষাঙ্গনে। কারণ টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তার, সিট দখল প্রভৃতি।
তিন মন্ত্রী ও দুজন অ-মন্ত্রী নেতা প্রতিদিন উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করছেন, বাংলাদেশ সন্ত্রাসী ও জঙ্গিতে ভরে গেছে। তা যে গেছে তা ওপরের প্রতিবেদনগুলোর পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায়। সন্ত্রাসী ও জঙ্গি তৎপরতার নায়কেরা অতি আদরে-সোহাগে, স্নেহ-মমতায় লালিত-পালিত। বাংলাদেশে চাকরিবাকরি বা কোনো ক্ষেত্রেই যোগ্যতা মাপকাঠি নয়। চাকরির সঙ্গে চাপাতির সম্পর্ক। চাপাতিঅলারাই চাকরিতে অগ্রাধিকার পাবে। এরাই ২০১৯-এর নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে সহায়তা করবে। এদের দিয়েই মোবাইল কোর্ট বসিয়ে জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া
হবে, বিসিএস পরীক্ষার ভাইভার দিন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত নিজের ছবিটি দেখালেই প্রশাসন বা পুলিশ ক্যাডারপ্রাপ্তি অবশ্যম্ভাবী।
একবার এক অমৃতের সন্তানকে দূরে ডেকে জিগ্যেস করেছিলাম, তোমরা যে মারামারিতে দক্ষতা অর্জন করেছ, তোমার বাপ-চাচাদের কি মারামারি করতে দেখেছ? তোমাদের এলাকার ফসলের মাঠে কৃষকদের কি মারামারি করতে দেখেছ? তাঁতি বা জেলেদের মারামারির রেকর্ড কোথায়? ছেলেটি বলল, এসব না করলে হাইকমান্ডের কাছে কোনো দাম নেই।
হাইকমান্ডকে পরামর্শ দেওয়ার ধৃষ্টতা আমাদের নেই। সব দোষ সন্ত্রাসে লিপ্ত ছাত্রদের ঘাড়েও চাপানো ঠিক হবে না। এ পথ থেকে তাদের দূরে রাখতে শিক্ষকদের সম্মিলিত ভূমিকা কী? শিক্ষার্থীদের জীবন বড় না নিজের চাকরি বড়? অমৃতের পুত্রদের বাবা-মায়েরা টেলিভিশনে ও পত্রিকায় তাঁদের সন্তানদের দেখে চিনতে পারেন না? এ পাপের দায় সবাইকেই নিতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে জানাই সমবেদনা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷