‘তা সে যতই কালো হোক’ -উম্মে মুসলিমা |
নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য অবসানের সনদ—কনভেনশন টু এলিমিনেট অল ফরম্স অব ডিসক্রিমিনেশন অ্যাগেইনস্ট উইমেন (সিডও) সনদে কোথাও বর্ণবৈষম্যের কথার উল্লেখ নেই। অনুচ্ছেদ ২-এর খ ও ঙ-তে যথাক্রমে বলা আছে ‘নারীর প্রতি সকল ধরনের বৈষম্য নিষিদ্ধ করে উপযুক্ত ক্ষেত্রে আইন মানতে বাধ্য করার ব্যবস্থাসহ যথোপযুক্ত আইনগত ও অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা।’ ‘কোনো ব্যক্তি, সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান যাতে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করতে না পারে তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সকল উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ।’ অনুচ্ছেদ ৫-এর ক-এ আছে, ‘পুরুষ ও নারীর মধ্যে কেউ উৎকৃষ্ট কেউ নিকৃষ্ট এই ধারণার ভিত্তিতে কিংবা পুরুষ ও নারীর চিরাচরিত ভূমিকার ভিত্তিতে যেসব কুসংস্কার, প্রথা ও অভ্যাস গড়ে উঠেছে, সেগুলো দূর করার লক্ষ্যে পুরুষ ও নারীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আচরণের ধরন পরিবর্তন করা।’
এর ভেতরেই হয়তো বর্ণবৈষম্যের কথাটা ঊহ্য আছে কিন্তু বর্ণবৈষম্য যেহেতু বিশ্বব্যাপী আলোচিত সন্ত্রাসের একটি, সেহেতু আলাদাভাবে এটার উল্লেখ থাকার প্রয়োজন ছিল। সিডওতে এটার উল্লেখ থাকলে আমাদের নারী উন্নয়ন নীতিতেও এর প্রভাব পড়ত। কারণ, আমাদের এ দেশে সাদা-কালোর বৈষম্যের কারণে যে প্রকৃতির নির্যাতন বা বঞ্চনার ঘটনা ঘটে, সাদাদের দেশে তা ঘটে না। ইউরোপ-আমেরিকায় সব ধরনের নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়ন, একই রেস্টুরেন্টে খাওয়া, পাশাপাশি বসা, গণমাধ্যম, শিল্পকারখানা, স্থানান্তরকরণ, স্বাস্থ্য, সম্পদ, রাজনীতি, আইন, বিচার ইত্যাদিতে যেভাবে কালোরা বৈষম্যের শিকার, বিয়ের ব্যাপারে ততটা নয়। কারণ, বিয়ে বা একত্রে বসবাস ওখানে নারী-পুরুষ নিজেদের পছন্দে করে থাকেন বলে কালো নারীরা শুধু কালো হওয়ার জন্য তালাক বা সম্পর্ক ভাঙনের সম্মুখীন হন না। আমাদের প্রস্তাবিত বিবাহ-সংস্কৃতির এ দেশে কালো মেয়ের বিয়ে হতে চায় না। হলেও তালাক হয়, না হয় যৌতুকের জন্য উপর্যুপরি নির্যাতনের শিকার হন।
গত বছরের ১ জুন পটুয়াখালীর বাউফলের মিতু আক্তার নামে এক গৃহবধূ ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে মারা যান। তিনি নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। কেন? না, তিনি কালো ছিলেন বলে বিয়ের পর তাঁকে প্রতিনিয়ত ‘কালো’ বলে শ্বশুরবাড়ির লোকজন খোঁটা দিতেন। একসময় আর সহ্য করতে না পেরে মিতু রাগে-দুঃখে আগুনে আত্মাহুতি দেন। প্রথম আলোয় প্রকাশিত কাবেরী গায়েনের ‘কালো মিতু ও ফরসা অন্ধকার’ লেখাটি এ বিষয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছিল সেই সময়। অন্য সব যোগ্যতা থাকার পরেও শুধু কালো হওয়ার কারণে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবেও নারীরা অনেক ক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার। কিন্তু কালো মেয়েদের জন্ম থেকে শুরু করে বিয়ে বা বিয়ে-পরবর্তী জীবনের ভয়াবহতার কাছে তা নগণ্য।
গৃহপরিচারিকা হিসেবে এক কালো মেয়ে এলেন এক বাড়িতে। তাঁর স্বামী তাঁকে তালাক দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন কেবল তিনি কালো বলে। এ মেয়েটি সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া জানা। তাঁর স্বামী যাঁকে আবার বিয়ে করেছেন, তিনি লেখাপড়া তো জানেনই না, উপরন্তু হাভাতে ঘরের। তাঁর যোগ্যতা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত ‘রস’ গল্পের খলনায়িকার মতো, যাঁর কেবল গায়ের চামড়াই ফরসা। গৃহপরিচারিকা হিসেবে বছর চারেক কাজ করার পর কালো মেয়েটির গায়ের রং বেশ ঝকঝকে হলো, স্বাস্থ্যও ফিরল। একবার দেশে বেড়াতে গেলে তাঁর স্বামী তাঁকে দেখে পাগলপ্রায়। তত দিনে অভাবে-অনটনে, সন্তান প্রতিপালনে সেই দ্বিতীয় স্ত্রীর চেহারা-শরীর সবই নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু সেই কালো মেয়ে স্বামীর ঘরে ফিরে যাননি। স্বামী তাঁর নামে কেস করবেন বলে শাসালে তিনিও তাঁর বিনা অনুমতিতে পুনর্বিবাহের জন্য স্বামীর নামে পারিবারিক আদালতে মামলা করবেন বলে সাফ জানিয়ে দেন। আরও একজন উচ্চশিক্ষিত উচ্চবংশীয় ভদ্রলোক তাঁর দীর্ঘ প্রায় ৩৫ বছরের বিবাহিত জীবনে প্রতিদিন স্ত্রীকে কালো বলে খোঁটা দিয়েছেন। দ্বিতীয় বিয়ের হুমকিও দিয়েছেন। কালো স্ত্রী তাঁর অবস্থাপন্ন বাবার ঘরে ফিরে যাননি তিন সন্তান ফেলে, কিন্তু চোখের জল ফেলেছেন খুব। যেন কালো হওয়া তাঁর নিজেরই অপরাধ।
শক্তিপদ রাজগুরুর ‘মেঘে ঢাকা তারা’র নীতা এ দেশের কালো মেয়ের ভাগ্য নিয়ে প্রতিভাত। আবার অন্যদিকে নিমাই ভট্টাচার্যের ‘মেমসাহেব’ও কালো কিন্তু সে বেশ বরণীয়। মেমসাহেবের নায়কের মতো উল্টোপাল্টা সৌন্দর্যপিপাসু যে এ দেশে একেবারে নেই তা নয়, কিন্তু তাঁদের পিপাসা অন্যের গলা ভেজাতে পারে না। রবীন্দ্রনাথও খানিক সান্ত্বনা দিয়ে গেছেন ‘কৃষ্ণকলি’ লিখে। শরৎচন্দ্রের ‘অরক্ষণীয়া’কেও উদার হৃদয় নায়ক রক্ষা করেছেন। তাই মরমি কবি দুঃখ করে বলেন, ‘কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দো কেনে?’
এখনো এ দেশে পরিসংখ্যান হয়নি শুধু কালো হওয়ার কারণে কতজন নারী সামাজিকভাবে হেয় হয়েছেন, বিয়ে হয়নি, বিয়ে ভেঙেছে, তালাক হয়েছে, হত্যা বা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। পরিসংখ্যান করলে এর পরিমাণ নেহাত কম হতো না। সাম্রাজ্যবাদের শুরু থেকেই খুব বেশি কালো মেয়েরা রমণীয় নয়, এ রকম একটা ধারণা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে ইউরোপে।
এর পর থেকে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মাধ্যমে ক্রমাগত প্রচারণায় ফরসা মেয়েই সবার ইপ্সিত হয়ে আসছেন। উইকিপিডিয়ার বরাতে সারা বিশ্বে বার্ষিক ১৮ বিলিয়ন ডলারের প্রসাধনসামগ্রী বাজারে ছাড়া হয়। তাই সচেতন এক লেখিকা বলেন, ‘নৃতাত্ত্বিক কারণেই
যাদের ফরসা হওয়ার কথা না, তাদের মধ্যে ফরসা হওয়ার প্রবণতা ঢুকিয়ে দিয়েছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। আর এভাবেই মনোজগতে ফরসার প্রভাব বজায় রাখার শ্রেষ্ঠত্বকে পুঁজি করে বাজার বিকশিত হচ্ছে।’
এই বোধ হয় প্রথম বিজ্ঞাপনশিল্পে এক ব্যতিক্রম আমাদের দেশে উপস্থাপিত হলো এই বলে যে ‘ফ্রেশ মানেই সুন্দর’, যেখানে সাদা-কালোর সমতা আনার চেষ্টা করা হয়েছে। আমেরিকার বিখ্যাত কৃষ্ণকায় লেখিকা বেল হুকস দুঃখ করেছেন, ‘কালো মেয়েদের আগে মানুষ বলে বিবেচনা করা হোক’ বলে।
কেবল ‘কালো হরিণ–চোখ’ দেখে মুগ্ধ হলেই তো হবে না, কালো অঙ্গের মানুষটির সৌন্দর্যও খুঁজে নিতে হবে। কালো নিয়ে সুন্দর-অসুন্দরের ধ্যানধারণায় মানুষের মনের ওপর জোর খাটানো যাবে না, যতক্ষণ না কেউ নিজে থেকে তাঁর চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি ও সংস্কার পরিবর্তন করে সুশিক্ষিত হয়ে ওঠেন।
তবে কালো বলে নির্যাতন, গঞ্জনা, হত্যা, বঞ্চনার অভিযোগের আইনগত সমাধান আসা উচিত। স্পষ্টভাবে তা সিডও সনদ এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশের নারী উন্নয়ন নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করে নারী নির্যাতনের এই বেদনাদায়ক বিষয়টিকে বিতাড়নের ব্যবস্থা করতে হবে।
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক
lima_umme@yahoo.com