শেরপুরে ১২ শতাধিক চাতাল বন্ধ হওয়ার পথে : লক্ষাধিক শ্রমিক বেকারত্বের অপেক্ষায়
ধানের জেলা শেরপুর। অনেক আগে থেকেই এ জেলা চাল উদ্বৃত্ত অঞ্চল ও চালের খ্যাতি দেশব্যাপি। ব্যাপক ধান উৎপাদন হয় বলে স্বাধীনতার পরে থেকেই আস্তে আস্তে এখানে চাতাল শিল্পের সমৃদ্ধি ঘটে। মিল মালিক সূত্রে জানা গেছে, জেলায় বর্তমানে ১২ শতাধিক চাতাল মিল আছে। এর মধ্যে শেরপুর সদর উপজেলাতেই আছে ৮শ। ১২ শতাধিক চাতালে লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে যার মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ গ্রামের অসহায় মহিলা এবং ৮০ শতাংশের বয়স ষাটোর্ধ্ব। নানা সংকটে ১২শ চাতাল এখন বন্ধ হওয়ার পথে। আর এ শিল্পের সাথে জড়িত হাজার হাজার অসহায় নারীসহ লক্ষাধিক শ্রমিক বেকারত্ব বরণের অপেক্ষায় বলে মিল মালিক সূত্র জানিয়েছে।
জানা যায়, চাতাল ব্যবসাকে ঘিরেই শেরপুরের অর্থনীতি ছিল রমরমা। এখন অনেক রমরমা ব্যবসায়িরা লোকসান গুনতে গুনতে রাস্তায় দাড়ানোর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। গত ৫/৭ বছর ধরেই এ ব্যবসায় চরম মন্দা চলছে। কারন হিসেবে মিল মালিকরা জানিয়েছে, ভারত থেকে অবাধে চাল, কুড়া ও খুদ আমদানি, সম্প্রতি জেলায় মোটা মূলধন মালিকদের অটো রাইছ মিল করার প্রতিযোগিতা ও মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ীদের মূলধন স্বল্পতা ইত্যাদি। চাতাল মালিকদের অভিযোগ, কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে চাল করার পর উৎপাদিত চালের সাথে বাজারের চালের দর মিলেনা। উৎপাদিত চালের চেয়ে বাজারে কম দামে চাল পাওয়া যায় ফলে প্রতি লটেই কম বেশী লোকসান গুনতে হচ্ছে। ভারত থেকে অবাধে চাল আমদানি করা হচ্ছে। আমদানি করা এসব ভারতীয় চাল দেশী চালের চেয়ে দাম কম ফলে ক্রেতারা ওই চালই কিনছে। এর প্রভাব কৃষকদের উপরেও পড়ছে। দেশীয় চালের দাম ও চাহিদা কম থাকায় কৃষকরা ধানের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেনা। চাতাল মালিকদের অভিযোগ, নিজের চাতালে উৎপাদন করার ফলে চাল উৎপাদনের পরে কুড়া ও খুদ অবশিষ্ঠ থাকতো। এই অবশিষ্ঠ খুদ কুড়া বিক্রি করে কোন রকমে পুষিয়ে নিত চাতাল মালিকরা। সম্প্রতি এই খুদ কুড়াও আমদানি করা হচ্ছে ভারত থেকে। ফলে দেশীয় খুদ কুড়ার চাহিদা ও দাম কমেছে আশংকাজনক হরে। কয়েক হাজার খুদ কুড়া ব্যবসায়ি এখন বেকার। একে তো অবাধে ভারতীয় আমদান অপর দিকে মধ্যবৃত্ত এসব চাতাল মালিকের মরার উপর খারার ঘা হয়ে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে অটো রাইস মিল। জানা গেছে, ২/৩ বছরের মধ্যে জেলায় অন্তত: ৯টি অটো রাইস মিল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আরও ১৫টি প্রক্রিয়াধীন আছে। এ সমস্ত অটো রাইস মিলে চাল উৎপাদন করতে শ্রমিক ও সময় লাগে খুব কম ফলে উৎপাদন খরচ কমে যায়। সাধারন ও অটো মিলের উৎপাদিত চলের বাজার দরে থাকে ভিন্নতা। মধ্যবৃত্ত ব্যবসায়িদের মূলধন স্বল্পতার কারনে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে অটো মিল দিতেও পারছে না ফলে প্রতিযোগিতায় আর টিকে থাকতে পাচ্ছেনা। মিল মালিক সূত্র আরও জানিয়েছে, একটি অটো মিলে কোন রকম ঝুঁকিবিহীন ৮ জন শ্রমিক ১ দিনে ১শ টন চাল উৎপাদন করতে পারে। আর সাধারন চাতালে সমপরিমান চাল উৎপাদন করতে ৬শ জন শ্রমিক ও ১মাস সময় লাগে। তার উপরে নানা ঝুঁকিতো আছেই। শান্তা চাউল কলের মালিক আনিছুর রহমান জানান, সাধারন মিল মালিকরা অসহায় অবস্থায় আছে। ব্যাংক থেকে চড়া সুদ নিয়ে করা মিল বিক্রি করে দিয়ে অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে। শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ি আলহাজ জয়নাল আবেদিন ও আলহাজ হায়দর আলী জানান, যেভাবে ব্যবসা চলছে ১৫ সালের মধ্যে অন্তত ৬০ ভাগ মিল বন্ধ হবে। আমদানিকৃত ভারতীয় চাল বাজার দখল করে নিয়েছে। দেশীয় চাল, মিল মালিক, লক্ষাধিক শ্রমিক, হাজার হাজার কৃষক ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হলেও তাদের নিয়ে কারও ভাবনা নেই। খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ন দেখাতে গিয়ে দেশীয় শিল্পকে ধ্বংস করতে একটি মহল তৎপর। চাতাল মিলের সাথে সম্পৃক্ত শ্রমিকরা এখন ধুকে ধুকে মরবে। এব্যাপারে শেরপুর জেলা মিল মালিক সমিতির সাধারন সম্পাদক আছাদুজ্জামান রৌশন বলেন, ২/৩ বছরের মধ্যে শতাধিক মিল বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধের পথে আছে আরও অন্তত দু’শটি। গত কয়েক বছরের লোকসান গুনতে গুনতে অনেকেই মিলের মাঠ প্লট বানিয়ে বাসা বাড়ীর জন্য বিক্রি করে দিয়েছে।