চেয়ারম্যানকে সরাবে কে? এ কে এম জাকারিয়া
উড়োজাহাজ কেনা, বিদেশি উড়োজাহাজ লিজ, টেন্ডার বা নিয়োগ-পদোন্নতি—এসবে মাত্রাছাড়া দুর্নীতির অভিযোগ, অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে বছরের পর বছর ধরে লোকসান—এই ভাবমূর্তির বাংলাদেশ বিমান এখন ডুবতে ডুবতে তলিয়ে যেতে বসেছে। সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে জানা গেল, প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অনেকেই সোনা চোরাচালানের মতো অপকর্ম করে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি যে সোনা চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, সে অনুমান অবশ্য নতুন নয়। কারণ, নিয়মিতই যখন বিমানবন্দরে সোনার চালান ধরা পড়ে (প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ২০ মাসে এক হাজার ১৮ কেজি), তখন সাধারণ বুদ্ধি-বিবেচনাতেই বোঝা যায়, আরও অনেক চালানই পার পেয়ে যায়। একই সঙ্গে এটাও অনুমান করা খুবই স্বাভাবিক যে বিমানের উচ্চপর্যায়ের লোকজন জড়িত না থাকলে এটা সম্ভব নয়।
কিন্তু এভাবেই চলছিল এবং ১২ নভেম্বর বিমানের একজন কেবিন ক্রু সোনাসহ আটক না হলে এবং সবকিছু স্বীকার না করলে যেভাবে চলছিল সেভাবেই চলত। তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিমানের ৬৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী এই চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত এবং তাঁদের মধ্যে বিমানের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত শীর্ষ কর্মকর্তারাও রয়েছেন। গোয়েন্দা পুলিশ তিন কর্মকর্তাসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডেও নিয়েছে। বিমানের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল জামাল উদ্দিন আহম্মেদ সোনা চোরাচালানে বিমানের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার ঘটনায় ‘বিস্ময়’ প্রকাশ করেছেন। সোনা চোরাচালানের সঙ্গে চিফ অব প্ল্যানিং ও শিডিউলের কাজে জড়িত ক্যাপ্টেন শহীদের মতো সিনিয়র পাইলটের যুক্ততায় তিনি ‘হতবাক’ হয়েছেন। আসলে এই ‘বিস্ময়’ ও ‘হতবাক’ হওয়ার মধ্যেই বিমানের ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা ও দুর্নীতিই যে প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
সোনা চোরাচালানের সঙ্গে যে সিনিয়র ক্যাপ্টেনের যুক্ততায় বিমানের চেয়ারম্যান ‘বিস্মিত’ হয়েছেন, তিনি শুধু নিছক একজন পাইলটই নন; তিনি সব বৈমানিকের শিডিউল ঠিক করেন, কে কখন কোথায় যাবেন। অনেকটা বৈমানিকদের নেতার মতো। প্রশ্ন হচ্ছে, সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন, এমন একজন এই পদে নিয়োগ পান কীভাবে? অথবা ফ্লাইট সার্ভিস শাখার ডিজিএম বা ব্যবস্থাপক (তাঁদের কাজ বিমানের কেবিন ক্রুদের দায়িত্ব বণ্টন)? এসবের দায় কি বিমানের পরিচালনা পর্ষদ বা এর চেয়ারম্যান এড়াতে পারেন? গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, ক্যাপ্টেন শহীদের চাকরির মেয়াদ বাড়াতে ৩০ লাখ টাকা ঘুষের লেনদেন হয়েছে।
বিমানের এবারের সোনা চোরাচালান কেলেঙ্কারির সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র হচ্ছে এক ‘ধর্মপুত্র’।
তিনি বিমানের কেউ নন, কিন্তু আবার সবই। বিমানের বিভিন্ন সূত্র, পুলিশ ও ডিবিকে উদ্ধৃত করে প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, কোনো পদে না থেকেও তিনি নিয়মিত বিমান কার্যালয়ে যেতেন, ‘সবাই তাঁকে সমীহ করে চলত’, তিনি বিমানবন্দর এলাকায় ‘অতি প্রভাবশালী’।
চাকরির মেয়াদ বাড়াতে ক্যাপ্টেন শহীদ এই ধর্মপুত্রকে ৩০ লাখ টাকা দিয়েছেন বলে গোয়েন্দা পুলিশকে জানিয়েছেন। ‘ধর্মপুত্র’ টাকা নেওয়ার কথা স্বীকারও করেছেন। তিনি বিমানের কেউ না হয়েও যখন কারও চাকরির মেয়াদ বাড়াতে ঘুষ নিতে পারেন এবং তাতে যদি কাজ হয়, তবে তাঁর ক্ষমতার বিষয়টি টের পাওয়া যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্মপুত্রের হাত ঘুরে এই ঘুষের টাকা কার কার হাতে গেল? চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর ক্ষমতা যাঁদের, তাঁদের কাছেই নিশ্চয়।
এই ধর্মপুত্রের সূত্রে বিমানের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ব্যক্তিগতভাবেই জড়িয়ে গেছেন এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে। সব কটি সূত্রই বলেছে, বিমানের চেয়ারম্যানের ‘ধর্মপুত্র’ পরিচয় দিয়েই সব অপকর্ম করে গেছেন মাহমুদুল হক পলাশ। পুলিশের কাছেও তিনি নিজেকে বিমানের ঠিকাদার ও বিমানের চেয়ারম্যানের ‘ধর্মপুত্র’ হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। এখন চেয়ারম্যান যতই বলুক ‘ধর্মপুত্র কেমনে হয়’, পলাশের বিমানবন্দর ও বিমান অফিস দাপিয়ে বেড়ানোর কথা তিনি জানতেন না, তা কোনোভাবেই বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। ‘ধর্মপুত্রের’ দায় বিমানের চেয়ারম্যানকে নিতেই হবে, নিতে হবে তাঁর অপকর্মের দায়ও।
জামাল উদ্দিন আহম্মেদ বিমানের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ২০০৯ সালে। এর আগের দুই অর্থবছর বিমান লাভ করেছিল। তিনি চেয়ারম্যান নিয়োগ পাওয়ার পর প্রতিবছরের লোকসানের হিসাবটিই বিমানের চেয়ারম্যানের কর্মদক্ষতার মান তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট। ২০০৯-১০ সালে বিমান লোকসান দিয়েছে ৪৬ কোটি টাকা, ২০১০-১১-তে ১৯৯ দশমিক ৪৯ কোটি, ২০১১-১২-তে ৬৫০ কোটি, ২০১২-১৩-তে ১৯৩ কোটি আর ২০১৩-১৪-এর প্রথম ছয় মাসে লোকসান ২২২ কোটি। লোকসানের ক্ষেত্রে ধারাবাহিক ‘সাফল্য’ দেখিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এর আগে ২০০৭-০৮ ও ২০০৮-০৯ এই দুই অর্থবছরে বিমানের লাভ হয়েছিল ২০ কোটি টাকার বেশি। দেখা যাচ্ছে, নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ পাওয়ার পর এক অর্থবছরেই (২০০৯-১০) লোকসান হয়েছে আগের দুই বছরের লাভের প্রায় দ্বিগুণ। লাভের এই বছর দুটি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। বিমানকে সে সময়ে কোম্পানি করা হয়েছে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালনার জন্য। যার ফল পাওয়া গিয়েছিল পরের দুই বছর। এটা পরিষ্কার যে দক্ষভাবে পরিচালনা করা গেলে বিমানকে লাভজনক করা সম্ভব।
বিমান একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। অন্য এয়ারলাইনসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই একে ব্যবসায় টিকে থাকতে হয় এবং লাভ করতে হয়। আর এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দক্ষ ব্যবস্থাপনাই হলো আসল কথা। ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন ও দক্ষতার ওপর জোর দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম লাভজনক এয়ারলাইনসে পরিণত হওয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ। বাংলাদেশে বিমান নিয়ে আগে এক লেখায় এই প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছিলাম। যুক্তরাজ্যে তখন মার্গারেট থ্যাচারের রক্ষণশীল সরকার ক্ষমতায়। লোকসান দিয়ে চলছে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ। সরকার জাতীয় পতাকাবাহী এই প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক করার জন্য এর বেসরকারীকরণ ও লন্ডন শেয়ারবাজারে শেয়ার ছাড়ার উদ্যোগ নেয়। এই কাজ সফল করার জন্য ১৯৮১ সালে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় একজন সফল ব্যবসায়ীকে—জন কিং। এয়ারলাইনস ব্যবসার ইতিহাসে তিনি অদক্ষ একটি জাতীয় বিমান সংস্থাকে বিশ্বের অন্যতম ব্যবসাসফল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার নায়ক হিসেবে বিবেচিত। দায়িত্ব নিয়ে তিনি অদক্ষ ও কাজে লাগে না, এমন ২২ হাজার কর্মীকে বিদায় করেন। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ দেন আরেক সফল ব্যবসা নির্বাহী কলিন মার্শালকে। বহর থেকে পুরোনো ও লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা উড়োজাহাজ বাদ দিয়ে নতুন ও আধুনিক উড়োজাহাজ কেনেন, অলাভজনক রুটগুলো বাতিল করেন। ১৯৮৭ সালে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বেসরকারীকরণ হয় এবং শেয়ারবাজারে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের বিপরীতে জমা পড়া চাঁদার পরিমাণ ছিল ১১ গুণ বেশি।
বাণিজ্যের এই যুগে এসেও বাংলাদেশ বিমানের মতো একটি প্রতিষ্ঠান চলছে সাবেক সামরিক আমলার নেতৃত্বে। কোনো দেশের বাণিজ্যিক এয়ারলাইনসগুলোর সঙ্গে সে দেশের সামরিক বিমানবাহিনীর সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া কঠিন। সামরিক শাসন আমাদের দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামরিকায়নের যে সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছে, বেসামরিক শাসনের যুগেও সেটাই চলছে। বাংলাদেশ বিমান মানেই এর শীর্ষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাবেন বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা! বেসামরিক বাণিজ্যিক এয়ারলাইনস পরিচালনার মতো একটি বিশুদ্ধ ব্যবসার সঙ্গে বিমানবাহিনীর একজন কর্মকর্তার, তা তিনি তাঁর পেশায় যতই দক্ষ ও চৌকস হন না কেন, কী সম্পর্ক থাকতে পারে? ১১ সদস্যের যে বোর্ড বিমান পরিচালনা করে, সেখানে চেয়ারম্যানসহ চারজনই সামরিক কর্মকর্তা। পাশের দেশ ভারতে এয়ার ইন্ডিয়ার পরিচালনা পর্ষদে মাত্র একজন সদস্য আছেন বিমানবাহিনী থেকে।
বিমানের ‘ধর্মপুত্র’ কেলেঙ্কারির পর এ নিয়ে সংসদে বেশ তর্ক-বিতর্ক, এমনকি বিমানের চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিতে ওয়াকআউটও হলো। গত সংসদে বিমানের সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনে নাকি বিমানের চেয়ারম্যানকে ‘চোর’ ও ‘অথর্ব’ বলা হয়েছে, সে তথ্য সংসদে প্রকাশ করেছেন জাতীয় পার্টির সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ। তিনি সেই প্রতিবেদন সংসদে প্রকাশ ও আলোচনা করারও দাবি জানান। জাসদের সাংসদ মঈন উদ্দীন খান বিমানের চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ করে সংসদে বলেছেন, কিছু মানুষ সুপার সিটিজেনের সুবিধা ভোগ করেন, তাঁদের চাকরির মেয়াদ কখনো শেষ হয় না। (প্রথম আলো, ২৪ নভেম্বর)
বিমানের বর্তমান চেয়ারম্যান যে ‘সুপার সিটিজেনের’ সুবিধা ভোগ করছেন, সেটা স্পষ্ট। গত ছয় বছরে বিমানমন্ত্রী বদল হয়েছেন তিন দফা। রদবদল হয়েছে পরিচালনা পর্ষদ ও এমডি পদেও। কিন্তু লোকসান ও অনিয়ম দুর্নীতির এত অভিযোগের পরও চেয়ারম্যান পদের কোনো নড়চড় হয়নি। বোঝা যায় তাঁর খুঁটি খুবই শক্ত। তাঁকে সরাবে কে? সে ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের নেই। বিমানে চেয়ারম্যান কে হবেন, তা ঠিক করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, তাঁকে সরানোর ইচ্ছা-অনিচ্ছাও তো তাহলে সেখান থেকেই আসতে হবে। শত শত কোটি টাকা লোকসান, অনিয়ম, অদক্ষতা ও দুর্নীতির অভিযোগ তো গেল, ‘ধর্মপুত্র’ কেলেঙ্কারির পর সেখান থেকে কী সিদ্ধান্ত আসে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com