ডা. মিলনের স্বপ্ন ও বিপন্ন গণতন্ত্র – সেলিনা আখতার
আজ ২৭ নভেম্বর। ডা. শামসুল আলম খান মিলনের ২৪তম শাহাদাত দিবস। ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর ছিল জেনারেল এরশাদ সরকার প্রণীত গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতির প্রতিবাদে চিকিৎসকদের কর্মবিরতি। বেলা ১১টায় বর্তমান আইপিজিএমআর হাসপাতালে বিএমএর পরবর্তী কর্মসূচি আলোচনার একটি সভা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা তখন ভয়ানক উত্তপ্ত। এরশাদ-সমর্থক ছাত্রসংগঠনের মাস্তানরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে একটি মাইক্রোবাস নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র ছাত্রদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। উদ্দেশ্য ছিল ঐক্যবদ্ধভাবে ছাত্ররা যেন মিছিল করতে না পারেন।
এ সময় জেনারেল এরশাদের প্রয়োজন ছিল একটি বড় মাপের মৃত্যু, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণার জন্য। স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধাচরণকারী নেতা হিসেবে ডা. মিলন ছিল সরকারের চিহ্নিত। সকাল ১০টায় মিলন রিকশাযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের রাস্তা ধরে পিজি হাসপাতালের দিকে রওনা হয়। পাবলিক লাইব্রেরির কোনায় টিএসসি চত্বরে পৌঁছালে ১০০ গজ দূর থেকে তাকে গুলি করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে মিলন রাস্তায় ঢলে পড়ে। ঘাতকের লক্ষ্যভেদী একটি গুলির আঘাত ডা. মিলনের জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দেয়। মিলনের সমাজবদলের স্বপ্ন অসমাপ্ত থেকে যায়। এই হত্যার সংবাদ অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো জেগে ওঠে সমগ্র জাতি। পুলিশ, বিডিআর, আনসার—কোনো বাহিনীই সেদিন রুখতে পারেনি বিক্ষুব্ধ জনতার স্রোতকে। বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করল উনসত্তরের মতো আরেক গণ-অভ্যুত্থান। ২৭ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে সরকারের দমননীতি। কারফিউ জারি করেও জনতার আন্দোলন স্তব্ধ করতে সক্ষম হয়নি সরকার। অবশেষে স্বৈরাচারী সেনাশাসক পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণিটি নানাভাবে আলোচিত ও বিতর্কিত। একদিকে তারা যেমন সুবিধাবাদী বলে আখ্যায়িত হয়, অন্যদিকে জাতির ক্রান্তিকালে গণ-আন্দোলনে তাদের ভূমিকাই মুখ্য হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, স্বাধীনতা আন্দোলন, সর্বশেষ নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান—সব কটি আন্দোলন মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান ও অংশগ্রহণে সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে পেশাজীবী সংগঠনগুলো বিশেষ ভূমিকা পালন করে। স্বাধীনতার পর এই প্রথম বাঙালি জাতি যেন নতুন করে স্বাধীনতার স্বাদ পেল, গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগের সুযোগ পেল। কিন্তু নির্বাচিত সরকারগুলো বারবার তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সমাজে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দলবাজি, স্বজনপ্রীতি আর দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে। চলেছে গুম, হত্যা ও সহিংসতার রাজনীতি। দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব স্বকীয়তা হারিয়েছে বা তাদের দলীয়করণ করা হয়েছে।
বর্তমানে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের জন্য মোটেই স্বস্তিদায়ক ও সুখকর নয়। ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ধারা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। বিরোধী দলবিহীন সংসদ কার্যক্রম চলছে। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনকালে নির্বাচন-প্রক্রিয়া নিয়ে যে জটিলতাগুলো ছিল, আজও সেগুলোর কোনো সমাধান হয়নি। রাজনীতির অঙ্গনে আশির দশক থেকে সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী ও সামরিক-বেসামরিক আমলাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তাই রাজনীতি তার নিজস্ব চরিত্র হারিয়েছে। রাজনীতি এখন রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। এ কারণেই হয়তোবা আমাদের বিজ্ঞ রাজনীতিবিদেরা নির্বাচনকালীন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা প্রবর্তনে ব্যর্থ হয়েছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচন যে কারণে জাতীয় জীবনে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে রয়েছে আজও। আমি মনে করি, এখনো সময় আছে, ভবিষ্যতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া প্রয়োজন, জনগণ চায় সব রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে রাজনীতিবিদেরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানে পৌঁছাবেন, যাতে ভবিষ্যতে নির্বাচনকালে জনগণকে আর কোনো হানাহানি, সংঘর্ষ ও জ্বালাও-পোড়াওয়ের দুর্ভোগ পোহাতে না হয়।
অনেক হতাশা ও অনিশ্চয়তার মধ্যেও নব্বইয়ের পর এই ২৪ বছরে বাংলাদেশ ধীরগতিতে এগিয়ে চলেছে। দৈনিক পত্রিকাগুলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে উন্নয়ন সূচকের বেশ কিছু সূচকে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তান থেকে এগিয়ে আছে। যেমন: শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, উন্নত পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থাগুলোর ক্ষেত্রেও গত দুই দশকে বাংলাদেশ অনেকটা সফলতা অর্জন করেছে। বর্তমানে খাদ্য উৎপাদনেও আমাদের সফলতা অনস্বীকার্য। দেশের এই সফলতাগুলো আমাদের মনে আশার সঞ্চার করে, গর্বে বুক ভরে ওঠে। বাংলাদেশের মানুষ প্রকৃতপক্ষে অত্যন্ত সহনশীল ও উদ্যোগী। সে কারণে ব্যক্তি-উদ্যোগ ও সরকারের সাহায্য-সহযোগিতায় অনেক না পাওয়ার মধ্যেও এই সফলতাগুলো অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।
অপার সম্ভাবনার বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে রাজনীতির অঙ্গনকে কলুষমুক্ত করতে হবে। আর এই কাজগুলো সম্পন্ন করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সত্যিকারের দেশপ্রেমী, ত্যাগী তরুণসমাজকে রাজনীতিতে এগিয়ে আসতে হবে সর্বোচ্চ ত্যাগের আকাঙ্ক্ষা বুকে নিয়ে। সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজি করে যারা সাময়িকভাবে লাভবান হচ্ছে, তাদের সন্তানেরা তাদের কখনো শ্রদ্ধার চোখে দেখবে না, কোনো দিন তাদের ক্ষমা করবে না। সমাজে সম্মানের সঙ্গে তারা কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের একদিন আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবে। সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেক মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীতে কিছু ভালো কাজ করার জন্য, যা পরকালে তার পাথেয় হয়ে থাকবে। শহীদেরাও এই কথাটি মনে রেখেই তাঁদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির কল্যাণের জন্য। আমরা যারা বেঁচে আছি, আমাদের উচিত তাঁদের অসমাপ্ত কাজগুলো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, তাঁদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
শহীদ ডা মিলন এক গণতান্ত্রিক, সুখী, সমৃদ্ধ ও শান্তিময় বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আমরা যেন তাঁর এই স্বপ্নের কথা ভুলে না যাই। যেন না ভুলি যে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানের অঙ্গীকারও ছিল এমন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা।
সেলিনা আখতার: শহীদ ডা. মিলনের মা।