সাবেক মেজর জেনারেলসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ
সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জালাল উদ্দীন আহমেদসহ চারজনের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা দায়েরের সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর অনুসন্ধানকারী দল। গত মঙ্গলবার অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন কমিশনের কাছে দাখিল করেছে বলে দুদকের একটি নির্ভরযোগ্য নিশ্চিত করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা প্রিয়.কম-কে জানান, তাদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের প্রমাণ পেয়েছে অনুসন্ধানকারী দল। তাই মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ৪ (২) ও ৪ (৩) ধারায় তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা অনুমোদনের সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। সূত্র জানায়, আগামী সপ্তাহে কমিশনের নিয়মিত বৈঠকে এই মামলার অনুমোদন দেয়া হতে পারে।
অনুসন্ধানকারী দলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘ধারা বহুমুখী সমবায় সমিতি লি.’’-এর সভাপতি সাবেক মেজর জেনারেল জালাল উদ্দীন আহমেদ ও প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে তার স্ত্রী-ছেলে-মেয়েকে জড়িত। তারা হলেন যথাক্রমে প্রতিষ্ঠানটির সহ-সভাপতি আলিয়া ফাতেমা, সাধারণ সম্পাদক তালহা আহমেদ, যুগ্ম সম্পাদক রাদিয়া আহমেদ। তাদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে।
দুদক সূত্রে জানা যায়, অনুসন্ধান ও ঘটনাস্থল পরিদর্শন, সংগৃহিত রেকর্ডপত্র ও অভিযোগকারী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবানবন্দি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মেজর জেনারেল (অব) জালাল উদ্দীন আহমেদ ২০০৫ সালে নিজ পরিবারের সদস্য ও নিজস্ব লোকজন নিয়ে ‘‘ধারা বহুমুখী সমবায় সমিতি লি.’’ নামে একটি সমিতি গঠন করেন। যা জেলা সমবায় কার্যালয়, ঢাকা থেকে ২০০৫ সালের ১৭ই জুলাই নিবন্ধন গ্রহণ করা হয়।
দুদকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, জালাল উদ্দীন আহমেদ ও তার স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে ব্যক্তিগতভাবে ঢাকা সেনানিবাসের আশপাশের এলাকা মাটিকাটা, মানিকদী, কাফরুল, ইব্রাহিমপুর এলাকায় বসবাসরত অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত সেনা সদস্য, তাদের আত্মীয়-স্বজন এবং পরিচিতজনদের ‘‘ধারা বহুমুখী সমবায় সমিতি লি.’’-এ এফডিআর রাখার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। তারা এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দেন যে, অন্য কোথাও বা ব্যাংকে অর্থ বা টাকা জমা রাখলে তারা কম লভ্যাংশ পাবেন। তিনি (জালাল উদ্দীন) সমিতির মাধ্যমে অনেক ব্যবসা বাণিজ্যের সাথে জড়িত। তার সমিতিতে অর্থ জমা রাখলে মাসে মাসে লাখ প্রতি দুই হাজার টাকা লভ্যাংশ প্রদান করবেন। আর গচ্ছিত আসল টাকা ফেরত চাইলে ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে তা ফেরত দিবেন।
এতে আরও উল্লেখ করা হয়, সাবেক মেজর জেনারেল জালাল উদ্দীন আহমেদের মতো সিনিয়র সেনা অফিসারের মিথ্যা আশ্বাসে প্রলুব্ধ হয়ে ‘প্রতি মাসে এক লাখ টাকায় দুই হাজার টাকা লভ্যাংশ পাবেন’ -এমন শর্তে ১৪৪৯ জন সদস্য বিভিন্ন অংকের অর্থ এককালীন ‘‘ধারা বহুমুখী সমবায় সমিতি লি.’’ এর নামে রশিদের মাধ্যমে জমা দেন। এভাবে প্রতিটি জমা রশিদে এই সেনা কর্মকর্তা ‘‘ধারা বহুমুখী সমবায় সমিতি লি.’’ এর চেয়ারম্যান হিসেবে নিজে স্বাক্ষর করে ১৪৪৯ জন সদস্যের কাছ থেকে এফডিআরের নামে ৫৯ কোটি ৩৯ লাখ ১ হাজার ৪৫৪ টাকা গ্রহণ করেন।
দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, জালাল উদ্দীন আহমেদ ‘‘ধারা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি.’’ এর নামে এফডিআর স্লিপের মাধ্যমে এত বিপুল অংকের অর্থ গ্রহণ করলেও এই সমিতির নামে ব্যাংকে কোনো হিসাব খুলে এসব অর্থ জমা না করে তিনি এই বিপুল পরিমাণ অর্থ অন্যত্র হস্তান্তর করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একজন কর্মকর্তা প্রিয়.কম-কে বলেন, এফডিআর প্রদানকারী সদস্যরা জালাল উদ্দীন আহমেদ এক পর্যায়ে সমিতির নামে ভাড়া নেয়া ইউ.এ.ই. মৈত্রী কমপ্লেক্স, এপার্টমেন্ট নং ০৪, এফ/২ বাড়ি নং-০২, সড়ক নং-১৭, ব্লক-সি, বনানী ঢাকার অফিসটি বন্ধ করে আত্মগোপন করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জালাল উদ্দীন আহমেদ অসৎ উদ্দেশ্যে প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে নিজে সভাপতি সেজে এবং স্ত্রী আলিয়া ফাতেমাকে সহ-সভাপতি, ছেলে তালহা আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক ও মেয়ে রাদিয়া আহমেদকে যুগ্ম সম্পাদক করে ‘‘ধারা বহুমুখী সমবায় সমিতি লি.’’ নামে সমিতিটি গঠন করেন। পরবর্তীতে ১৪৪৯ জন সদস্যের কাছ থেকে এফডিআরের নামে নগদে ৫৯ কোটি ৩৯ হাজার ১ হাজার ৪৫৪ টাকা সমিতির নামে কোনো হিসাব না খুলে এই অর্থ অন্যত্র পাচার পূর্বক আত্মসাত করায় এটি মানি লন্ডাতিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ৪ (২) ও ৪ (৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
দুদক সূত্রে জানা যায়, আমানতকারীদের এ অর্থ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ছেলে ও মেয়ের কাছে পাচার করেছেন সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা। ২০১২ সালের জুনে কিছু সংখ্যক গ্রাহক তাদের জামানত ফেরত চাইলে জালাল উদ্দীন আহমেদ তা দিতে গড়িমসি করেন। ডিসেম্বরে অডিটের কথা বলে ২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারি জামানত ফেরত দেবেন বলে জানান তিনি। কিন্তু ওই দিনও জামানত ফেরত দিতে ব্যর্থ হন। এই পরিস্থিতিতে তিনি গোয়েন্দা সংস্থা, মিলিটারি পুলিশ, লজিস্টিক এরিয়া কমান্ডার, স্টেশন কমান্ডার ও প্রভোস্ট মার্শাল ঢাকার উপস্থিতিতে ২০১৩ সালের ১ থেকে ১৩ জুলাইয়ের মধ্যে সব টাকা পরিশোধ করবেন বলে মুচলেকাও দেন। এরপর ওই তারিখেও টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হন তিনি। পরবর্তীতে জালাল উদ্দীন আহমেদ ট্রাস্ট ব্যাংকের একটি যৌথ একাউন্ট (জালাল উদ্দীন আহমেদ ও আমানতকারী) থেকে দুটি চেকের মাধ্যমে ৫ কোটি টাকা গ্রাহকদের প্রদান করেন। কিন্তু তার ওই একাউন্টে কোনো টাকা ছিল না। পরে জালাল উদ্দীন আহমেদের পাসপোর্ট ক্যান্টনমেন্ট নির্বাহী অফিসার জব্দ করেন এবং ক্যান্টনমেন্ট নির্বাহী অফিসার বোর্ড মিটিং ডাকলে আমনতকারীরা ও জালাল উদ্দীন আহমেদের মধ্যে চার কিস্তিতে অর্থ পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়। এরপরও তিনি সময়মতো টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হন।
গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, একাধিকবার কথা দিয়েও টাকা ফেরত না দিয়ে ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে তিনি আত্মগোপনে চলে যান।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের আগস্টে দুদকের কাছে সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) জালাল উদ্দীন আহমেদ, তার স্ত্রী ও প্রতিষ্ঠানের একাধিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ৮২ কোটি টাকা অর্থ পাচারের অভিযোগ আসে। এরপর সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে তা অনুসন্ধানে তিন সদস্য বিশিষ্ট অনুসন্ধানকারী টিম গঠন করে কমিশন। অবশ্য এর আগে ভুক্তভোগীরা আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। এই মামলাটি এখনো সিআইডি তদন্ত করছে। সূত্রে জানা গেছে, সিআইডির তদন্তের ধীরগতির কারণে ভুক্তভোগীরা দুদককে অভিযোগ করলে অনুসন্ধান শেষে কমিশনে মামলার সুপারিশ জানিয়ে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।