সঙ্গীত মঞ্চ থেকেই না ফেরার দেশে কাইয়ুম চৌধুরী
উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত মঞ্চে পড়ে গিয়েই না ফেরার দেশে চলে গেলেন প্রবীণ ও বরেণ্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের মঞ্চে বক্তব্য দেওয়ার সময় রবিবার রাত পৌনে ৯টার দিকে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়ে যান তিনি।
সেখান থেকে তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেওয়া হলে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। সিএমএইচের কমান্ড্যান্ট নাসির উদ্দিন আহমেদ তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের লিটু দ্য রিপোর্টকে জানান, সঙ্গীতানুষ্ঠান শুরুর আগে রাত ৮টা ৪০ মিনিটে কাইয়ুম চৌধুরী মঞ্চে বক্তৃতা দিয়ে নেমে যাওয়ার পর বক্তৃতা দিচ্ছিলেন ড. আনিসুজ্জামান। এরপর তিনি আবার ফিরে এসে মঞ্চে উঠতে চাইলে আমি তাকে মাইকের কাছে নিয়ে যাই। এ সময় তিনি বলেন, আমার একটি কথা বলার আছে।
আবুল খায়ের লিটু জানান, এরপরই তিনি (কাইয়ুম চৌধুরী) পড়ে যান এবং সাথে সাথে তাকে সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রীসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তাদের কোনো সন্তান নেই।
কাইয়ুম চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৪ সালের ৯ মার্চ ফেনীতে। চিত্রশিল্পের নানা শাখা বিশেষ করে চিত্রশিল্প, প্রচ্ছদশিল্প, তেলচিত্র, রেখাচিত্র, জলরং, ছাপচিত্র ইত্যাদি ক্ষেত্রে তিনি অসামান্য অবদান রেখে গেছেন।
কাইয়ুম চৌধুরীর বাবা আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী ছিলেন সমবায় বিভাগের পরিদর্শক। পরবর্তীতে তিনি সমবায় ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। নোয়াখালীতে গোপাল হালদারের সঙ্গে ছিল তাঁর সখ্য। কুমিল্লায় গায়ক মোহাম্মদ হোসেন খসরু এবং লোকগানের সাধক শচীন দেববর্মণের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল প্রগাঢ়। চট্টগ্রামের আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদের সঙ্গে তাঁদের পারিবারিক যোগাযোগ ছিল। বাবার বদলির চাকরির সুবাদে কাইয়ুম চৌধুরী বাংলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ফিরেছেন।
শিক্ষা জীবন
মক্তবে কাইয়ুম চৌধুরীর শিক্ষার হাতেখড়ি। তারপর ভর্তি হন চট্টগ্রামের নর্মাল স্কুলে। এরপর কিছুকাল কুমিল্লায় কাটিয়ে চলে যান নড়াইলে। চিত্রা পাড়ের এই শহরে কাটে তাঁর তিনটি বছর। সেখান থেকে সন্দ্বীপে এসে ভর্তি হন প্রথমে সন্দ্বীপ হাই স্কুলে ও পরে কারগিল হাই স্কুলে। এরপর নোয়াখালী জেলা সদরে কিছুকাল কাটিয়ে পিতার সঙ্গে তাঁর ঠাঁই হয় ফেনীতে। এখানে এসে ভর্তি হন ফেনী হাই স্কুলে, সেখান থেকে যান ফরিদপুরে। ফরিদপুর থেকে ময়মনসিংহ এসে ১৯৪৯ সালে সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন।
স্কুল জীবন থেকেই আঁকাআঁকির প্রতি ঝোঁক ছিল কাইয়ুম চৌধুরীর। ১৯৪৯ সালে আর্ট ইনস্টিটিউটে (চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাবি) ভর্তি হয়ে কাইয়ুম চৌধুরী কৃতিত্বের সঙ্গে শিক্ষা সমাপন করেন ১৯৫৪ সালে। তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন শিল্পচার্য জয়নুল আবেদীনকে। সদ্যপ্রতিষ্ঠিত আর্টস ইন্সটিটিউটের নবীন শিক্ষার্থীরা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ইমদাদ হোসেন, মুর্তজা বশীর, আমিনুল ইসলাম, দেবদাস চক্রবর্তী প্রমুখ ছিলেন প্রতিবাদী আয়োজনের নিরলসকর্মী এবং সকল মিছিলের পুরোভাগে। অন্তর্মুখী স্বভাবের কাইয়ুম চৌধুরীরও সম্পৃক্ত ছিলেন।
কর্মজীবন
১৯৫৫ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত কাইয়ুম চৌধুরী নানা ধরনের ব্যবহারিক কাজ করেছেন। বিজ্ঞাপনী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন আর বইয়ের প্রচ্ছদ ও সচিত্রকরণের কাজ করেছেন। সিগনেটের বই কাইয়ুম চৌধুরীর জন্য ছিল এক অনুপম নিদর্শন। সাময়িক পত্রিকা বিষয়ে আগ্রহী কাইয়ুম চৌধুরী, ছায়াছবি নামে একটি চলচ্চিত্র সাময়িকী যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেছিলেন কিছুকাল। সুযোগমতো টুকটাক প্রচ্ছদ আঁকছিলেন এবং এই কাজের সূত্রেই পরিচয় সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে। ১৯৫৫ সালে তাঁর দুই বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন। কিন্তু প্রকাশক অপারগ হওয়ায় সে বই আর আলোর মুখ দেখেনি। প্রচ্ছদে একটি পালাবদল তিনি ঘটালেন ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত জহুরুল হকের সাত-সাঁতার গ্রন্থে। গ্রন্থের বক্তব্যের বা সারসত্যের প্রতিফলন ঘটালেন প্রচ্ছদে। একই সঙ্গে গ্রাফিক ডিজাইনে কুশলতা ও নতুন ভাবনার ছাপ মেলে ধরলেন। এমনি দক্ষতার যুগল মিলনে আঁকলেন ফজলে লোহানী রচিত ‘কথাসরিত্সাগর’-এর প্রচ্ছদ যা প্রকাশিত হয়নি। গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের সচিত্র সন্ধানী পত্রিকার আত্মপ্রকাশ তাঁর অঙ্কন, টাইপোগ্রাফিবোধ ও রসসিঞ্চিত তির্যক রচনা প্রকাশের মাধ্যমে হয়ে উঠেছিল অনবদ্য। ১৯৫৭ সালে কাইয়ুম চৌধুরী আর্ট কলেজে শিক্ষকতায় যোগ দেন।
শিল্প ভাবনা
১৯৫৭ সালে সতীর্থ আমিনুল ইসলাম ও সৈয়দ জাহাঙ্গীরকে নিয়ে কাইয়ুম চৌধুরী গিয়েছিলেন কলকাতায়। ব্রিটিশ কাউন্সিলের তরুণ কর্মকর্তা জিওফ্রে হেডলির আহ্বানে এই সফর। কলকাতায় দেখা করেছিলেন সত্যজিত রায় ও খালেদ চৌধুরীর সঙ্গে। ১৯৫৯ সালে বন্ধুবর গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের সন্ধানী প্রকাশনী যাত্রা শুরু করে জহির রায়হানের ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে। ১৯৬১ সালে মাওলা ব্রাদার্স সৃজনশীল প্রকাশনার অধ্যায় উন্মোচন শুরু করে আবদুশ শাকুরের ‘ক্ষীয়মাণ’ এবং সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যগ্রন্থ ‘একদা এক রাজ্যে’র মাধ্যমে। এই দুই প্রকাশনা সংস্থার কাজের পেছনে বরাবরই কাইয়ুম চৌধুরী সক্রিয় ছিলেন। তিনি ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’র প্রচ্ছদ আঁকেন। ১৯৫৯ এবং ১৯৬১ সালে রেলওয়ের টাইমটেবিলের প্রচ্ছদ এঁকে সেরা পুরস্কার লাভ করেন কাইয়ুম চৌধুরী। তিনি ১৯৬০ সালে তাহেরা খানমের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। যিনি ছিলেন আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়া প্রথম চারজন ছাত্রীর একজন। তার শৈল্পিক প্রয়াসের পেছনে স্ত্রীর ভূমিকা প্রেরণাদায়ক ছিল। ১৯৬১ সালে ডিজাইন সেন্টার ছেড়ে অবজাভার হাউজে চিফ আর্টিস্ট হিসেবে যোগদান করেন। অবজারভার পত্রিকার রবিবারের সাময়িকীতে ডিজাইন নিয়ে যেসব নিরীক্ষা করতেন তার শিক্ষক জয়নুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
শিল্পরীতি
তেল রঙ, জল রঙ, কালি-কলম, মোমরং, রেশমছাপ ইত্যাদি নানা মাধ্যমে কাইয়ুম চৌধুরী কাজ করেছেন। তাঁর একটি প্রবণতা জ্যামিতিক আকৃতির অনুষঙ্গ। বস্তুত তাঁর ছবি নকশা প্রধান। বর্ণিল পটভূমিতে মোটাদাগের নকশা তাঁর প্রধানতম অঙ্কনশৈলী। অন্যদিকে কাইয়ুম চৌধুরীর চিত্রাবলী বর্ণোজ্জ্বল; এই দিক থেকে আঁরি মাতিসের সঙ্গে তাঁর সমিল লক্ষ্যণীয়। লাল, নীল, সবুজ এই তিনটি রং তিনি প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করতেন। এই বর্ণভঙ্গী তাঁর চিত্ররীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাঁর ক্যানভাসের আয়তন প্রায়শ বর্গাকার। এছাড়া তাঁর চিত্রাবলিতে এদেশের লোকশিল্পসুলভ পুতুল, পাখা, হাঁড়ি, শীতলপাটি, কাঁথা ইত্যাদির পুনঃপৌণিক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
সম্মাননা
শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ২০১০ সালে সুফিয়া কামাল পদক এবং ২০১৪ সালে শহীদ আলতাফ মাহমুদ পদকে ভূষিত হন।