বীরাঙ্গনা ফাতেমার কথা- আমরা অপরাধী ছিলাম না, পরিস্থিতির শিকার
রাজধানী ঢাকার সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে আয়ার কাজ করেন শেখ ফাতেমা আলী। রাত হলে কোনো একটা ফাঁকা স্থানে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। ছুটির দিনে মানুষ যখন তার চোখের সামনে দিয়ে স্বজনের বাড়ি যায়, একে অন্যের কুশল বিনিময় করে ফাতেমা তখন তাদের দেখেন। নিজের অসহায়ত্ব নিয়ে নিজেকে উপহাস করেন। নিজেকে প্রশ্ন করেন ‘আমার জীবনটা এমন কেন? কেন আমার কেউ নেই? কী অন্যায় ছিল আমার?’ এ সব ভাবতে ভাবতে আনমনা হন।
একের পর এক রোগীর সেবা করে তাদের করুণা ভিক্ষা করে ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করেন ফাতেমা। পারতপক্ষে কোনো কথা বলেন না ফাতেমা। আবার কাউকে পেলে ডান হাত বুকের বাম পাশে ভর করে জীর্ণশীর্ণ দেহটাকে দুলাতে দুলাতে বলে চলেন পেছনের সোনা ঝরা দিনগুলোর কথা।
দ্য রিপোর্টের সঙ্গে সম্প্রতি কথা হয় শেখ ফাতেমা আলীর। তিনি বলেন, সে দিন (’৭১ সাল) আমার একটা ঘর ছিল, বাড়ি ছিল। ছিল ঝলমলে একটা সংসার। বাবা-মা, ভাই-বোনদের সাথে গোপালগঞ্জের তাড়াইল গ্রামে সারাবেলা উল্লাসে ফাটিয়ে দিতাম। অবাধ বিচরণে কোথাও কারো মানা নেই।
কথার মাঝে একটু থামেন ফাতেমা। এই থেমে থাকার মধ্যেও এক ধরনের ব্যথাতুর অভিব্যক্তি ফুটে উঠে তার চোখে মুখে। আবার বলতে শুরু করেন অন্য পর্ব। যে কথার পরতে পরতে বেদনার নীলাভ উচ্চারণ। আমাদের যা গৌরবের, অহংকারের তার প্রতিটি ক্ষণের সঙ্গে তার অস্তিত্ব জড়িত। কিন্তু সম্মানের বদলে কলঙ্কের অভিশাপ নিয়ে তেতাল্লিশ বছর অতিক্রম করেছেন তিনি। সমাজ আর স্বজনের ধিক্কার নিয়ে চরম একাকিত্বে বেঁচে আছেন ফাতেমা বেগম। ফাতেমার সামনে স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা বললে রেগে যান।
তিনি বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের নাম বিক্রি করে তো বহুদিন চলছে। আসল উদ্দেশ্য সফল হবে কবে? এই যুদ্ধ আমার সম্ভ্রম কেড়ে নিয়ে আমাকে করেছে যাযাবর। অথচ আমার খবর কেউ নিল না কোনোদিন। শুধু আমার কেন? কত শত নারীর গায়ে কলঙ্কের ছাপ বসিয়েছে পাকিস্তানপ্রেমী পিশাচ রাজাকাররা। আমার কী দোষ ছিল সে দিন?’
এ সময় আরও রেগে যান ফাতেমা। অনেকটা প্রলাপের সুরে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে চলেন ‘আমি কি পতিতা? আমি কি বেশ্যা? আমি কি নষ্টা?’ এরপর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার স্বাভাবিক হন তিনি।
ফাতেমার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি থাকতেন স্বামীর বাড়ি গোপালগঞ্জে। ১৫ বছরের ফাতেমার কোলে তখন ৩ মাসের কন্যাশিশু। সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। প্রতিনিয়ত মানুষের মৃত্যু সংবাদ এলেও ফাতেমার সে দিকে নজর ছিল না। তার ধারণা ছিল— দেশে যতই বিশৃঙ্খলা থাকুক নিম্ন-মধ্যবিত্তদের কোনো সমস্যা হবে না।
ফাতেমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হল কিছুদিন পরেই। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তাদের বাড়িতে হামলা করে পাকিস্তানী বাহিনী, তাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। তারপর উপর্যুপরি পাশবিক নির্যাতন করে নালার পানিতে ফেলে চলে যায়। কয়েকদিন পর বীরবিক্রম হেমায়েতের সহযোগীরা তাকে উদ্ধার করে নাড়িকেল বাড়ি ক্যাম্পে নিয়ে যায়।
ফাতেমা বলেন, ‘সবকিছু হারিয়ে আমার মধ্যে তখন এইসব মানুষরূপী নরপশুদের হত্যার ইচ্ছা তীব্র হয়। বীরবিক্রম হেমায়েতের নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। যুদ্ধ শেষ হল, দেশ স্বাধীন হল। মানুষের মনে কত আনন্দ দেখলাম। রাজাকারদেরও মুক্তিযোদ্ধার খেতাব পেতে দেখলাম। কিন্তু আমি, আমরা ফাতেমা আলীরা আজ পর্যন্ত বঞ্চিতই থেকে গেলাম। একের পর এক কাগজ দেখালাম, সেক্টর কমান্ডারের সার্টিফিকেট দেখালাম। কিন্তু শুধু প্রতিশ্রুতি ছাড়া কিছুই পেলাম না। বীরাঙ্গনা কিংবা মুক্তিযোদ্ধার খেতাব না পেয়ে পেলাম বেশ্যা-বেহায়ার খেতাব। স্বামী, সন্তান, সমাজের অবহেলায় বেড়ে উঠেছি। বেঁচে আছি একটা কারণে। যদি রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয় তাহলে এইসব নিন্দুকদের মুখে কাগজ ছুড়ে দিয়ে বলতে পারব আমি কোনো অপরাধী ছিলাম না। আমরা কেউ অপরাধী ছিলাম না। পরিস্থিতির শিকার। আমি রাষ্ট্র অর্জনের গৌরবের অংশীদার হতে চাই। জানি না কবে হবে, কীভাবে হবে।’
এরপর আর কোনো কথা বলতে চান না ফাতেমা। তার আর কী বা বলার আছে।