করপোরেট প্রতিষ্ঠানের দৌরাত্ম্য পানির দরে আর পানি নেই
মাহবুবুল হোসেন একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মাঠকর্মী। সারাদিন শহরের নানাপ্রান্তে ছুটে বেড়ান পলিসি পাওয়ার আশায়। রোজকারের মতো ক্লায়েনটের খোঁজে শনিবার ধানমন্ডির সোবাহানবাগে গিয়েছিলেন। দুপরে অনেকখানি হেঁটে ক্লান্ত মাহবুব পানির তৃষ্ণা মেটাতে জারের পানির খোঁজ করেন। জারের পানি না পেয়ে পকেটে থাকা ২০ টাকার ১৫ টাকা দিয়ে আধা লিটার পানি কিনতে বাধ্য হন তিনি। নদীমাতৃক বাংলাদেশে প্রকৃতির কৃপায় বিস্তৃত জলরাশি থাকলেও করপোরেট বাস্তবতায় খাবার পানি কিনতে হচ্ছে চড়া দামে।
মাহবুবুল হোসেন বলেন, কাজের তাগিদে ঢাকায় থাকি। আমাদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় খাবার পানির অভাব নেই। আর ঢাকা শহর যেন মরুভূমি! ধানমন্ডির মতো অভিজাত এলাকায় জারের পানিও মিলছে না। তাই বাধ্য হয়ে হাফ লিটার পানি ১৫ টাকায় কিনলাম। সামান্য পানি খেতে এত টাকা খরচ করা আমার জন্য বিলাসিতার সামিল।
এ যেন ফকির লালন শাহের সেই গানের পুনরাবৃত্তি—‘লালন মরলো জল পিপাসায় থাকতে নদী মেঘনা, হাতের কাছে ভরা কলস তৃষ্ণা মেটে না।’ পানি আছে কিন্তু পানযোগ্য পানির কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করেই মুনাফা গুনছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) অর্থনৈতিক শুমারির প্রতিবেদন অনুযায়ী দশ বছরের ব্যবধানে দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি প্রায় দ্বিগুণের চেয়ে বেশি বেড়েছে। এ সময় বর্তমান শুমারিকালীন মোট অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা ৮০ লাখ ৭৫ হাজার ৭০৪টি পাওয়া গেছে। এ সব ইউনিটে কর্মরত রয়েছে বিপুল পরিমাণ শ্রমজীবী মানুষ। ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি খাবার উপযোগী না হওয়ায় বিকল্প উপায়ে বোতলজাত পানির দিকে বিরাট ভোক্তাশ্রেণী তৈরি হয়েছে আর এ সুযোগ নিচ্ছে শীর্ষ করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো।
বিএসটিআই সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে পানি বাজারজাতে লাইসেন্স রয়েছে ১১০টি প্রতিষ্ঠানের। এর মধ্যে বোতলজাত পানি উৎপাদন করছে পারটেক্স গ্রুপের মাম, সিটি গ্রুপের জীবন, আকিজ গ্রুপের স্পা, প্রাণ গ্রুপের প্রাণ, মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ও একমি গ্রুপের একমি। ট্যারিফ কমিশনের নির্ধারিত দামের তোয়াক্কা না করে প্রতিষ্ঠানগুলো চড়া দামে পানি বিক্রি করছে সাধারণ মানুষের কাছে।
ট্যারিফ কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, ৫০০ মিলিলিটার ধারণক্ষমতার একটি বোতল তৈরিতে খরচ হয় ৩ টাকা ৬৭ পয়সা। এর সঙ্গে লেবেলিংয়ে ১ টাকা ও অন্যান্য ব্যয় হয় আরও ৩৭ পয়সা। সব মিলিয়ে আধা লিটার ধারণক্ষমতার একটি বোতলের জন্য খরচ দাঁড়ায় ৫ টাকা ৪ পয়সা। আধা লিটার পানি পরিশোধনে খরচ হয় ১ টাকা। এ হিসাবে ৫০০ মিলিলিটার পানি উৎপাদনে খরচ হচ্ছে ভ্যাটসহ ৬ টাকা ৯৫ পয়সা। আর ভোক্তাকে গুনতে হচ্ছে ১৫ টাকা। একই হিসাবে এক লিটারের একটি বোতলের দাম সর্বোচ্চ ৭ টাকা ১২ পয়সা। এর সঙ্গে পরিশোধন ও আনুষঙ্গিক খরচ যোগ করলে এক লিটার পানি বোতলজাতে খরচ পড়ে সর্বোচ্চ ১০ টাকা ৪৯ পয়সা। অথচ খুচরা পর্যায়ে তা বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকায়।
এ বিষয়ে পারট্রেক্স বেভারেজের কমার্শিয়াল বিভাগের ডিজিএম মুনিরুজ্জামান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ট্যারিফ কমিশনের হিসাব সঠিক নয়। পানির দামের চেয়ে বোতল, লেভেলিং করতে খরচ বেশি হয়। এ কারণে আমরা বেশি দাম রাখতে বাধ্য হচ্ছি।
এ বিষয়ে প্রাণ গ্রুপের মিডিয়া এ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের এ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার কে এম জিয়াউল হক বলেন, পানির বোতল তৈরিতে লেভেলিংসহ আনুষঙ্গিক খরচ একটু বেশি পড়ে যায়। যে কারণে আমাদের বিক্রিতে খরচ বেশি।
এ বিষয়ে সিটি গ্রুপের মালিকানাধীন জীবন ড্রিংকিং ওয়াটারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ট্যারিফ কমিশনের হিসাব অনুযায়ীই আমাদের উৎপাদন খরচ হয়। তবে মার্কেটিং, ডিস্ট্রিবিউটর, ট্রেডিংসহ অন্যান্য ভোক্তাপর্যায়ে একটু বেশি দামে বিক্রি হয়।
একমির ড্রিংকিং ওয়াটারের ব্র্যান্ড ম্যানেজার সাকিব করিম নীহান বলেন, উৎপাদন খরচ কম হলেও সাপ্লাই চেইনে খরচ বেশি হয়, যে কারণে ভোক্তাদের একটু বেশি দিতে হচ্ছে। পুরো প্রক্রিয়াটা বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভরশীল।
যারা বোতলজাত পানি পান করতে পারছে না তারা পান করছে জারের পানি। বাজার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এক জার নিম্নমানের মিনারেল ওয়াটারের উৎপাদন খরচ পড়ে ৮ থেকে ১০ টাকা। প্রতি জারে পানি থাকে ২০ লিটার। গ্লাসের হিসাবে এক জারে পানি হয় ন্যূনতম ৭৫ গ্লাস। এ হিসেবে নিম্নমানসম্পন্ন এক গ্লাস পানির মূল্য পড়ে ১৩ পয়সা।
খিলগাঁওয়ের হামিম ড্রিংকিং ওয়াটারের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ সেলিম বলেন, আমরা দোকানদারদের কাছে ৫০ পয়সা করে বিক্রি করি। ন্যূনতম লাভ তো রাখতেই হবে।
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকার হোটেল রেস্টুরেন্টগুলোতে ব্যবহার হচ্ছে নিম্নমানের পানির জার। কেবল তাই নয়, যে রেস্টুরেন্টে প্রতিদিন ২০ জার পানির প্রয়োজন পড়ে তারা কোম্পানির কাছ থেকে পানি রাখে ১০ জার। লাভ বাড়াতে হোটেলগুলোতে বাকি ১০ জার পানির চাহিদা মেটায় ওয়াসার লাইনের পানি দিয়ে। এর বাইরে রাস্তার ধারে ফুটপাতে যেসব টং দোকানে ফিল্টার পানি বিক্রি করতে দেখা যায় তার বেশিরভাগই সরবরাহ করে নামহীন পানি ব্যবসায়ীরা।
ঢাকা ওয়াসার উপ-প্রকৌশলী উত্তম রায় বলেন, ওয়াসা যে পানি উত্তোলন করে সেটা বিশুদ্ধ। এই পানি যখন পাইপ দিয়ে সাপ্লাই করা হয় তখন খাবার অনুপযুক্ত হয়ে পড়তে পারে। কারণ অনেক সময় পাইপ লিক হয়ে পানির সঙ্গে বাইরের জীবাণু প্রবেশ করে।
অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, সবার জন্য সুপেয় পানি নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। এটা কিন্তু খুব কঠিন কাজ নয়। ওয়াসার পানির প্ল্যান্ট উন্নত করার মাধ্যমেই নিরাপদ পানি সরবরাহ করা যায়। কিন্তু বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুযোগ করে দিতে সরকার এটা ইচ্ছা করে করছে না। এ কারণে ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ না মেনে পানি বিক্রিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো দাম নিচ্ছে।
বাণিজ্য সচিব হেদায়েত উল্লাহ আল মামুন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ট্যারিফ কমিশনের বেঁধে দেওয়া মূল্যের মধ্যে কেন পানি বিক্রি করা হচ্ছে না সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। আর নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেব। এ বিষয়ে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।