ঘাড় ও কোমর ব্যথায় আধুনিক চিকিৎসা
মানবদেহের ভেতরের কাঠামোর বড় অংশজুড়ে রয়েছে মেরুদণ্ড। এটি মানুষের শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ছোট ছোট অনেকগুলো হাড়ের সমন্বয়ে গঠিত হয় মেরুদণ্ড। এই ছোট হাড়গুলোর প্রতিটিকে আলাদা আলাদাভাবে কশেরুকা (ভাটিব্রা) বলা হয়। প্রতি দুটি কশেরুকার মাঝে চাপ শোষণকারী ডিস্ক থাকে, যা মেরুদণ্ডের এক হাড় থেকে অন্য হাড়কে আলাদা রাখে ও নড়াচড়া করতে সাহায্য করে। মানুষের মেরুদণ্ডে শক্ত হাড় ছাড়াও দুই হাড়ের মাঝখানে নরম হাড় (ইন্টারভার্টেব্রাল ডিস্ক) থাকে, যা গাড়ির স্প্রিং বা শক এ্যাবজরবারের মতো কাজ করে। এ সব হাড় কিংবা ডিস্কে কোনো ধরনের সমস্যা দেখা দিলে শরীরে বিভিন্ন ধরনের, বিশেষ করে কোমর ও ঘাড়ে ব্যথা দেখা দিতে পারে। নিচে সে বিষয়ে আলোচনা করা হল—
ঘাড় ও কোমর ব্যথার কারণ
সাধারণত ভারী জিনিস উঠানো, আঘাত, শরীরের বিশেষ অবস্থায় ঝাঁকি খাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে ডিস্কের স্থানচ্যুতি (প্রোলাপ্স) ঘটে। এর কারণে সংলগ্ন মেরুরজ্জু (স্পাইনাল কর্ড) অথবা স্নায়ুমূল (নার্ভরুট) অথবা উভয়ের উপরেই চাপ পড়তে পারে। কোমরের (লাম্বার) ডিস্ক প্রোল্যাপ্সে রোগী কোমর বা মাজায় তীব্র ব্যথা অনুভব করে। ফলে রোগী বসতে বা দাঁড়াতে পারে না।
কোমরে উৎপন্ন স্নায়ুসমূহ (নার্ভ) কোমর থেকে পা পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকে। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে মাজা ব্যথার পাশাপাশি একপাশ বা উভয় পাশের রান, হাঁটু, হাঁটুর নিচের গোছা, গোড়ালী বা পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত যেকোনো জায়গায় ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এ ছাড়াও শরীরের এ সব জায়গায় ঝিন-ঝিন, শিন-শিন করে, পায়ের বোধ শক্তি কমে যায়, পর্যায়ক্রমে পা দুর্বল হয়ে যেতে থাকে এবং এক পর্যায়ে রোগী হাঁটতে, দাঁড়াতে এমনকি বসতেও পারে না।
অন্যদিকে মানুষের ঘাড়ে (সারভাইকাল) উৎপন্ন স্নায়ুগুলো ঘাড় থেকে হাত পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকে। কাজেই ঘাড়ের ডিস্ক প্রোল্যাপ্সে প্রাথমিক পর্যায়ে ঘাড়ের ব্যথার পাশাপাশি ডান বা বাম হাত বা উভয় হাতে ব্যথা অনুভূত হতে পারে। লাম্বার ডিস্ক প্রোল্যাপ্সের মতো এখানেও হাত ঝিন-ঝিন, শিন-শিন করে, হাতের বোধ শক্তি কমে যায়। এক পর্যায়ে হাত দুর্বল হয়ে যেতে পারে— এমনকি হাত-পা উভয়ই দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
মেরুদণ্ডের নরম হাড় বা ইন্টারভার্টেব্রাল ডিস্ক গঠনগতভাবে নিউক্লিয়াস প্যালপোসাস (কেন্দ্রমধ্যস্থিত জেলির মতো পদার্থ) এবং এ্যানিউলাস ফাইব্র্যোসাস (চারপাশের শক্ত ফাইবার বা আঁশ ও ছোট ছোট রক্তানালী) দিয়ে তৈরি। মানুষের দাঁড়ানো অবস্থায় বা ওজন বহনকালে কেন্দ্রে থাকা জেলির উপর চাপ পড়ে। কিন্তু শক্ত এ্যানিউলাস ফাইব্র্যোসাস সেই চাপ নিয়ন্ত্রণ করে ডিস্কের গঠন ঠিক রাখে। কিন্তু বেশি ওজন বহনে বা অনিয়ন্ত্রিত নড়াচড়ায় নিউক্লিয়াস প্যালপোসাসের উপর মাত্রাতিরিক্ত বা অসম চাপ পড়লে সেই অতিরিক্ত চাপ এ্যানিউলাস ফাইব্র্যোসাস আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ফলে নিউক্লিয়াস প্যালপোসাস এ্যানিউলাস ফাইব্র্যোসাস এবং কখনও কখনও এ্যানিউলাস ফাইব্র্যোসাস ছিড়ে কোনো একদিকে বের হয়ে আসে। ফলে মেরুরজ্জু (স্পাইনাল কর্ড) অথবা স্নায়ুমূল (নার্ভরুট) অথবা উভয়ের উপরেই চাপ পড়ে।
ঘাড় ও কোমর ব্যথার চিকিৎসা
১৯৩৪ সাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিতে পিঠের চামড়া, মাংস ও হাড়ের মাঝখান দিয়ে কেটে বেরিয়ে আসা বা প্রোল্যাপ্সড নিউক্লিয়াস প্যালপোস্যাসের অংশটুকু তুলে এনে স্নায়ু বা স্নায়ু রজ্জুর চাপকে প্রশমিত করা হয়। এ ছাড়া নিয়মিত ফিজিওথেরাপি গ্রহণের মাধ্যমে ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। গবেষণা বা ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে, পারকিউটেনিয়াস লেজার ডিস্ক ডিকম্প্রেশনের (পিএলডিডি) মাধ্যমে নির্দিষ্ট মাত্রার ও নির্দিষ্ট ধরনের লেজার রশ্মি প্রয়োগ করে অতি সহজেই নিউক্লিয়াস প্যালপোসাসের অংশবিশেষ বাষ্পায়িত করে এর অতিরিক্ত চাপ কমানো সম্ভব। ফলে স্থানচ্যুত (প্রোলাপ্সড) ডিস্ক পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে এবং স্পাইনাল কর্ড ও নার্ভরুটের উপর থেকে চাপ কমে রোগী স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
এ ছাড়া লেজারের অপটোথারমো মেকানিক্যাল স্টিমুলেশনের মাধ্যমে ছিড়ে যাওয়া এ্যানিউলাস ফাইব্র্রোসাসের পুরো ক্ষমতা রিপেয়ার বা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে হাড়, মাংস ও চামড়া কাটার যেমন প্রয়োজন হয় না, তেমনি রোগীকে অজ্ঞান করারও প্রয়োজন হয় না। ফলে, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগীর ক্ষেত্রেও লেজার সার্জারিতে তেমন কোনো সমস্যা দেখা দেয় না। আর হাড়-মাংস না কাটার ফলে লেজার প্রয়োগের স্থানও দুর্বল হয় না এবং ক্ষতচিহ্নও (স্কার) থাকে না— যে কারণে ভবিষ্যতে এই অংশে স্কারের টানের ব্যথা অনুভূত হয় না।
উন্নত বিশ্বে ডিস্ক প্রোল্যাপ্সের বেশির ভাগ রোগীরই এখন আর কেটে অপারেশন করা হয় না। সারভাইক্যাল/লাম্বার ডিস্ক প্রোলাপ্সের বেশির ভাগ রোগীই পারকিউটেনিয়াস লেজার ডিস্ক ডিকম্প্রেশনের (পিএলডিডি) মাধ্যমে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করে থাকে।
উল্লেখ্য, এই চিকিৎসায় যে ধরনের বা যে মাত্রার লেজার রশ্মি ব্যবহার করা হয়ে থাকে— তাতে কোনো রকম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা থাকে না বললেই চলে। আমেরিকার ফেডারেল ড্রাগ এ্যাডমিনিস্ট্রেশন ইতোমধ্যেই পিএলডিডিকে নিরাপদ চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশেও এখন হাড় ও মাংস না কেটে ঘাড় ও কোমর ব্যথাসহ মেরুদণ্ডের সমস্যার চিকিৎসা অত্যন্ত সফলভাবে করা হচ্ছে।
লেখক : ডা. মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী
লেজার সার্জারি বিশেষজ্ঞ
পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব লেজার সার্জারি এ্যান্ড হসপিটাল।