মুক্তিযোদ্ধাদের একবেলা খাওয়ানোর অপরাধে…
পনের বছর বয়সে বিয়ে হয় রাজিয়া খাতুনের। স্বামী-সংসার নিয়ে দিনগুলো বেশ সুখেই কাটছিল তার। বাঁধ ভাঙা আনন্দের দিনগুলোতে ১৯৭১ সালে দেশের অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধে তার জীবন মুখোমুখি হয় কঠিন বাস্তবতার। মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার দেওয়ার অপরাধে পাকিস্তানী সেনারা ধর্ষণ করে তাকে। ভেঙে যায় স্বপ্ন-সাধ-আহ্লাদ!
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। এতে খুশি বীরাঙ্গনা রাজিয়া। কিন্তু তার প্রশ্ন— ‘আমার ভাগ্যের কি কোনো পরিবর্তন আছে? মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিটাও মিলছে না।’
তিনি খানিকটা ক্ষোভ নিয়ে বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, মানুষের মনে ফুটে উঠছে নতুন বিশ্বাস। কিন্তু আমাদের অবস্থার কি কোনো পরিবর্তন হচ্ছে? আমার মুখে কাউকে খাবার তুলে দিতে বলছি না, শুধু স্বীকৃতি চাই। সেটা যদি না পারেন তাহলে কেউ যেন না বলেন, দুই লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে।’
রাজিয়া বলেন, ‘আমার জন্ম কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার পীরকাশেমপুর গ্রামে। তখন বয়স পনের। অভাবের কারণে আমাকে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের পরও ছোটদের সঙ্গে এক্কা -দোক্কা খেলতাম। স্বামীর ভালোবাসার সংসারে অভাব ছিল, কোনো অভিযোগ ছিল না।’
রাজিয়া জানান, ১৯৭১ সাল। প্রতিদিনের মতো সেদিনও শিশুদের সঙ্গে খেলায় মেতে উঠেছিল রাজিয়া। হঠাৎ বাড়ির পাশে গুলির শব্দ। কিছুক্ষণ পরেই বাড়িতে প্রবেশ করে কয়েকজন পাকবাহিনীর সদস্য। একজন রাজাকারও সঙ্গে ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের একবেলা খাওয়ানোর কারণে তাকে ধরে নিয়ে যায়। পাকসেনারা ধর্ষণের পর তাকে অচেনা, নির্জন এক স্থানে ফেলে দেয়। কতক্ষণ পর তার জ্ঞান ফিরে তা সে জানে না। শুধু দেখতে পায় জনবিচ্ছিন্ন এক অঞ্চল। কোনো রাস্তা খুঁজে পায় না সে। ভয়ে যখন অস্থির তখন দেখা পান ৮ নম্বর সেক্টরের হেমায়েত (বীরবিক্রম হেমায়েত উদ্দীন) বাহিনীর সদস্যদের। তারাই সঙ্গে করে নিয়ে যায় রাজিয়াকে। আশ্রয় দেয়, সেবা যত্ন করে। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা যোগায়।
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়। রাজিয়া ঢাকায় চলে আসেন। একদিন বাংলামোটর মোড়ে (তৎকালীন পাকমোটর) দেখতে পান নিজের স্বামীকে। ক্ষণিকের জন্য ইহজনমের সব দুঃখ ভুলে গেলেও হঠাৎই তার মন অন্য কথা বলে। সবকিছু ভুলে প্রিয়তম স্ত্রীকে কাছে নিতে চাইলেও আর কোনোদিন রাজিয়া স্বামীর সংসারে না যাওয়ার ঘোষণা দেন। নিজেকে তার বড় অপবিত্র মনে হয়, মনে হয় কোনোদিন তার স্বামী যদি কথা প্রসঙ্গে খোঁটা দেয়, তাহলে সহ্য করতে পারবেন না। অনেক কষ্টে স্বামীকে ফেরান রাজিয়া। এ বিচ্ছেদ মেনে নিয়ে চিরকালের মতো চলে যান রাজিয়ার স্বামী। অনেক বছর পর রাজিয়া জানতে পারেন তার স্বামী আর বেঁচে নেই।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সম্ভ্রম হারানো রাজিয়া এখন বড় অবহেলায় তেজগাঁও রেলগেটের পাশে বসবাস করেন। ভিক্ষার চাল দিয়ে তার চুলোয় উঠে ভাতের হাঁড়ি। রোগ, শোক ও বার্ধক্যজনিত সমস্যা নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি। যুদ্ধ তার সব কেড়ে নিয়েছে। এখনো কি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিটুকু মিলবে না?