প্রবাসে বাংলাদেশী নারী শ্রমিকের কান্না- ‘হায়রে! কেন যে হংকং গিয়েছিলাম’
এক সময় বাংলাদেশ থেকে শুধু ছেলেরা চাকরি নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাতেন। সময়ের ধারাবাহিকতায় এখন দেশ থেকে নারীদেরও কাজের জন্য বিদেশে যাওয়ার হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেড়েছে। জনশক্তি রফতানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিশ্বে খ্যাতি অর্জনে সক্ষম হয়েছে। এই খ্যাতির আড়ালে অনেক সময়ই চাপা পড়ে যায় বিভিন্ন দেশে চাকরি নিয়ে যাওয়া নারীদের নানা দুরবস্থা, অসহায়ত্ব, বিপর্যস্ত জীবনযাপনের তিক্ত অভিজ্ঞতা। ‘প্রবাসে বাংলাদেশী নারী শ্রমিকের কান্না’র দ্বিতীয় কিস্তি প্রকাশিত হল।
‘কথা ছিল ৮ ঘণ্টা কাজ করাবে। কিন্তু ভোর ৫টা থেকে রাত ১২টা, কখনও কখনও ১টা কিংবা ২টা পর্যন্তও কাজ করাতো। কমপক্ষে ১৯ ঘণ্টা কাজ করতে হত। থাকতে দিয়েছিল বাড়ির স্টোর রুমে। ঠিকমত খাবার দেওয়া হতো না। সকালে জুটত শুধু শুকনো রুটি এবং দুপুরে ও রাতে নুডলস। বাইরের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হতো না। এমনকি পরিবারের সঙ্গেও না। একরকম বন্দি জীবন ছিল আমার। অনেক কান্নাকাটি করার পর একটি মোবাইল থেকে দু’ এক মিনিট ফোন করতে দিতেন বাড়ির মালিক। তাও আবার পাসওয়ার্ড দিয়ে লক করে রাখা, যাতে তাদের সাহায্য ছাড়া আমি কল করতে না পারি। আমার চুল প্রায় কোমর ছাড়িয়ে যেত। কিন্তু জানি না কেন, একদিন তারা আমার চুল কেটে ছেলেদের মত ছোট করে দিল?’
স্বপ্নের নগর রাষ্ট্র হংকংয়ে দুঃস্বপ্নের মতো কেটে যাওয়া দিনগুলোর কথা দ্য রিপোর্টের কাছে এভাবে বলেন সুমি বিশ্বাস।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, ‘হায়রে! কেনই যে হংকং গিয়েছিলাম? কেনই বা এমন হলো? এত নির্যাতন সহ্য করে দেশে ফিরে হাতে পেলাম মাত্র ২৮ হাজার টাকা।’
সুমির বাড়ি চুয়াডাঙ্গায়। ২০১০ সালে এসএসসি পাস করেন তিনি। এরপর আর পড়ালেখা হয়নি তার। নিজধর্মের ছেলেকে বিয়ে না করায় গ্রাম ছাড়তে হয়। ঢাকায় এসে স্বামীর সঙ্গে পাতেন সংসার।
২০১৩ সালে পত্রিকায় হংকং যাওয়ার বিজ্ঞপ্তি দেখতে পান। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর উদ্যোগে সরকারিভাবে মাত্র ২০ হাজার টাকা খরচ করলে তিনি হংকং যেতে পারবেন। পাবেন মাসিক ৪০ হাজার টাকা।
ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিজ্ঞপ্তির নির্দেশনা অনুযায়ী বাড়ির পার্শ্ববর্তী দক্ষিণখান ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে নিজের নাম রেজিস্ট্রেশন করেন।
সুমি বলেন, ‘রেজিস্ট্রেশন করার ১০/১৫ দিন পর মোবাইলে একটি এসএমএস’র মাধ্যমে আমাকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়। ওই বছরের জুন মাসে মিরপুরে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে হংকংয়ের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ও স্কাইপির মাধ্যমে ইন্টারভিউ নিয়ে তারা আমাকে নির্বাচন করেন। আমার সঙ্গে সে সময় আরও কয়েকজন নারী নির্বাচিত হন। এরপর সেখান থেকে হাউজকিপার (গৃহকর্মী) ও চাইনিজ ভাষা শিক্ষায় তিন মাসের ট্রেনিং গ্রহণ করার পর আমাদের সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। ট্রেনিং চলাকালে রিক্রুটিং এজেন্সি মেসার্স সাদিয়া ইন্টারন্যাশনাল (আরএল-৪৯২) অভিবাসন ব্যয় ও প্রশিক্ষণ বাবদ আরও এক লাখ ৪০ হাজার টাকা দিতে বলে।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত অভিবাসন ব্যয় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাদিয়া ইন্টারন্যাশনালের মালিক নোমান বলেন, ‘শুধু প্রশিক্ষণ বাবদ ২০ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে। হংকংয়ে যেতে হলে বাকি টাকা দিতে হবে।’
‘‘তখন আমরা বলি, ‘এত টাকা আমাদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়।’ পরে সাদিয়া ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতায় আমরা প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে পুরো টাকা ঋণ নিয়ে তা এজেন্সিকে প্রদান করি। শর্ত ছিল প্রতিমাসের বেতন থেকে ২৫ হাজার ৩১৬ টাকা প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংককে পরিশোধ করতে হবে।’’
সুমি বলেন, ‘হংকং যাওয়ার আগে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছ থেকে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর, অঙ্গীকারনামা, বাড়ির দলিলের কপি, জামিনদার হিসেবে ঘনিষ্ঠ চার জনের তথ্য এবং আমার স্বামীর ব্যাংক এ্যাকাউন্টের একটি ব্ল্যাঙ্ক চেক জমা রাখেন। ২০১৩ সালের ৩০ আগস্ট আমি হংকংয়ের উদ্দেশে দেশ ছাড়ি। সে সময় আমার সঙ্গে আরও ১১ জন নারী ছিলেন। হংকংয়ে প্যাসিফিক গার্ডেন নামে এক এজেন্সি আমাদের রিসিভ করে তাদের অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে সাত দিন ঘরের কাজ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিয়ে একজনের বাসায় পাঠায়। থাকার জন্য সে বাড়ির স্টোর রুমে আমাকে জায়গা দেওয়া হয়।’
‘এ ছাড়া সারা বাড়িতে ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা লাগানো থাকায় ছোটখাটো কোন ভুল হলে ভিডিও ফুটেজ দেখে বাড়ির মালিক আমাকে শাস্তি দিতেন। এভাবে ১০ দিন কাজ করার পর গান শোনার অভিযোগ দেখিয়ে তারা আমাকে চাকরিচ্যুত করে এজেন্সিতে পাঠিয়ে দেয়।’
‘নিয়ম হলো- হঠাৎ করে চাকরিচ্যুত হলে পাওনা বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার খরচ চাকরিদাতা পরিশোধ করবেন। প্যাসিফিক গার্ডেন এজেন্সিতে বাড়ির মালিক আমার পাওনা পরিশোধ করে দিলেও আমাকে তা দেওয়া হয়নি।’
সুমি আরও বলেন, ‘চাকরি হারানোর পর এজেন্সিকে নতুন চাকরি দেওয়ার কথা বলি। এজেন্সি থেকে আমাকে জানানো হয়-চাকরি পাওয়া যাবে তবে ম্যাকাও দূতাবাসে ৬০ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। বাংলাদেশ দূতাবাস কোনো সমাধান না দিয়ে আমাকে একই কথা বলে। আমি বললাম, এত টাকা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। এ নিয়ম তো আমাকে আগে থেকে বলা হয়নি। তা হলে কেন টাকা দেব?’
‘টাকা দিতে না পারায় আমাকে প্যাসিফিক এজেন্সির লোকজন হংকং এয়ারপোর্ট থেকে একটি বিমানে তুলে দেয়। কিন্তু বিমানটি সরাসরি বাংলাদেশের ছিল না। আমাকে বলা হয়েছিল- বিমানটি প্রথমে দিল্লিতে যাবে, সেখানে এক ঘণ্টা অপেক্ষার পর বাংলাদেশের উদ্দেশে রওয়ানা দেবে। কিন্তু দিল্লিতে এক ঘণ্টা নয়, পুরো দুইদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমার কাছে কোনো টাকা ছিল না। শুধু পানি খেয়ে এই দুইদিন কাটিয়েছি।’
হংকং ফেরত এ নারী বলেন, ‘‘ঢাকায় আসার পর এজেন্সি সাদিয়া ইন্টারন্যাশনাল আমার হাতে মাত্র ২৮ হাজার টাকা তুলে দেয়। বাকি টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হলে ওই এজেন্সির মালিক নোমান বলেন, ‘আমরা তো শুধু মাধ্যম, আমাদের কিছু করার নেই। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে যান, তারা কিছু করতে পারবে।’’
‘জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অতিরিক্ত মহাপরিচালক জাভেদ আহমেদের সঙ্গে ৬/৭ বার দেখা করে হংকং থেকে নির্যাতিত হয়ে দেশে ফেরত আসায় ব্যাংকঋণের টাকা মওকুফ করার জন্য লিখিত আবেদন করলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। তবে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অতিরিক্ত মহাপরিচালক জাভেদ আহমেদ আমাকে মেয়ের মত দেখেন। তিনি জানিয়েছেন খুব দ্রুতই আমাদের জন্য ব্যবস্থা নেবেন।’
নির্যাতিত এ নারী বলেন, ‘প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের কাছে ঋণের টাকা মওকুফের জন্য লিখিত আবেদন করলেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তা গ্রহণ করেনি। এখন প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে আমাদের ও আমাদের ঋণের জামিনদারকে ফোনে বিভিন্নভাবে ঋণ পরিশোধের জন্য চাপ প্রয়োগ করছে। এমনকি মামলা দেওয়ার হুমকিও দিয়েছে।’
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যে জানা যায়, জানুয়ারি ২০১৪ পর্যন্ত ১৯টি দেশে দুই লাখ ৮৩ হাজার ২৯০ জন নারী শ্রমিক কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তা ছাড়া দালাল প্রতারক চক্র ও আদম ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে অবৈধপথে পাচার হয়েছেন বহু নারী।
একমাত্র লেবাননেই কর্মরত আছেন ৮১ হাজার ৭১০ জন বাংলাদেশী নারী শ্রমিক। দেশের এ নারী শ্রমিকদের অধিকাংশই কাজ করছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এবং বেশির ভাগই গৃহকর্মী। এ নারী শ্রমিকরা নিজেদের আর্থিক সচ্ছলতা অর্জনে থেকেও বেশি অবদান রাখছেন দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে।
বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা অভিবাসী শ্রমিক সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, কিছু কিছু দেশে নির্যাতনের মাত্রা মোটামুটি সহনীয় থাকলেও লেবানন ও কাতারে কর্মরত নারী শ্রমিকরা ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এসবের মধ্যে রয়েছে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক এবং যৌন নির্যাতনের মতো অনৈতিক প্রবৃত্তি। বিদেশে কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিকরা ভালো থাকলেও গৃহকর্মে নিয়োজিত বাংলাদেশী নারী শ্রমিকরা নানাবিধ নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
জাতিসংঘের লিঙ্গসাম্য ও নারীমুক্তি বিষয়ক দফতরের ব্যবস্থাপক নাহিদ এম আহমেদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘অভিবাসী শ্রমিকদের বিদেশে যাওয়ার খরচ শুধু টাকার অঙ্কে হিসাব করলেই চলবে না। এর একটা সামাজিক ব্যয়ও আছে। শ্রমিকেরা বাইরে যাচ্ছেন পরিবার ছেড়ে আর দেশও শ্রমশক্তি হারাচ্ছে। কত শ্রমিক যাচ্ছেন, কতজন ফেরত আসছেন, তারা কী সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন, সেগুলো ভালো করে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।’
আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংগঠনের (আইওএম) বাংলাদেশ মিশনের প্রধান শরৎ দাস বলেন, ‘বিদেশে নিয়ে যাওয়ার আগে নারী শ্রমিকদের কাজ করার সুযোগ, ঝুঁকি, চ্যালেঞ্জ ও সক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত করা জরুরি। উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন এবং প্রতিকূল অবস্থার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাদের করণীয় সম্পর্কে প্রস্তুত করাও আবশ্যক। সরকারের উচিৎ নারী শ্রমিক পাঠানোর আগে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে কঠিন শর্তে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি যথার্থভাবে সম্পাদনের পর নিজ দেশের দূতাবাসগুলোকে কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো মেয়ে যাতে শ্রমিক হিসেবে বিদেশে যেতে না পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। সবার আগে নির্যাতনের শিকার যে নারীশ্রমিকরা বিভিন্ন দেশে বন্দি অথবা আত্মগোপনে আছেন তাদের উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারি উদ্যোগ খুবই জরুরি।’
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অতিরিক্ত মহাপরিচালক জাভেদ আহমেদ বলেন, ‘বিদেশ থেকে যে সব নির্যাতিত নারী ফেরত এসেছেন তাদের ব্যাপারটি আমাদের মাথায় আছে। তাদের সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা চলছে। প্রয়োজনে তাদের আবারও অন্য কোনো দেশে পাঠানো হবে।’