সন্তান-সন্ততি দুনিয়ার সৌন্দর্য
মোহাম্মদ আলী এরশাদ হোসেন আজাদ: মহান আল্লাহ্র বিশেষ অনুগ্রহ সন্তান-সন্ততি। কবির ভাষায় ‘কোনো রূপলোকে ছিলি রূপকথা তুই- রূপ ধরে এলি এই মমতার ভূঁই…’ (শিশু জাদুকর : কাজী নজরুল ইসলাম)।
নারী জনমের পূর্ণতা ও পারিবারিক পরিমণ্ডলে মায়া-মমতার কোমল পরশ নিয়ে একটি শিশু জানান দেয় তার আগমনীবার্তা। নবজাতকের প্রত্যাশায় পারিবারিক আবহে দোলা দিয়ে যায় অপেক্ষার প্রহর- সবার মনে থাকে একটি সুস্থ-সুন্দর শিশুর আকাক্সক্ষা। নবজাতকের মাধ্যমেই মানব বংশ এগিয়ে যায় যুগ-যুগান্তরের পথচলায় শতাব্দী থেকে সহস্রাব্দে। মহান আল্লাহ্র বিশেষ অনুগ্রহ সন্তানাদির জন্ম প্রক্রিয়া থেমে গেলে তো মানুষ ও মানবতা বিলুপ্তির অন্ধকারে হারিয়ে যেত। তাই মহান আল্লাহ্ ‘মানব শিশুর’ জন্মরহস্য সম্পর্কে ধারণা দানের জন্য পবিত্র কোরআনের বাণীতে জানিয়ে দেন, ‘তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্তপিণ্ড থেকে’ (আলাক : ০২)।
সাধারণত প্রত্যেক নবদম্পতির স্বপ্ন, পরিকল্পনা আবর্তীত হয় তাদের বংশের দীপ জ্বালানোর জন্য। পরম করুণাময়ের দরবারে তাদের মোনাজাত থাকে- ‘হে আমাদের প্রতিপালক তুমি আমাদের এমন পরিজন (স্ত্রী-সন্তান) দান কর- যারা আমাদের চক্ষুর শীতলতা দানকারী হবে এবং আমাদের মুত্তাকিদের নেতা বানাও’ (ফুরকান : ৭৪)।
শুধু কি তাই, সন্তান-সন্ততি হল পিতা-মাতার জন্য জাগতিক সৌন্দর্য ও সাফল্যের বাহন। ওদের মাধ্যমেই পিতা-মাতা নিজেদের জীবনের অপ্রাপ্তি, অপূর্ণতার অবসান ঘটিয়ে সাফল্যের নতুন ভুবন রচনা করেন। কারণ, স্বামী-স্ত্রীর প্রেমপূর্ণ উচ্ছ্বাস ও ভালোবাসার স্মারক স্তম্ভ হল মানব শিশুর প্রিয়মুখ ও পবিত্র আগমন। মহান আল্লাহ্ বলেন, ‘ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য ও সুখ-শান্তির বাহন ও উপাদান’ (কাহাফ : ৪৬)।
সন্তান উৎপাদন, প্রতিপালনের মাধ্যমে প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে বংশধারা বিকশিত হয়। পারিবারিক নিরাপত্তা ও মমত্ববোধে একটি শিশু বেড়ে ওঠে আপন মহিমায়। নিজেকে মেলে ধরে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে, কেউ বা নিজেকে নিয়ে যায় অনন্যতার শিখরশীর্ষে। তখন তারাই হয়ে ওঠে পরিবার-সমাজের গণ্ডি পেরিয়ে দেশ-দেশান্তর বা বিশ্বের গর্বের ধন। মানব শিশুর জন্ম তাই কখনওই অবহেলার নয়।
সন্তান প্রত্যাশীজনেরাও ‘পুত্র’ বা ‘কন্যা’র জন্য হয়ে যান দ্বিধাবিভক্ত। কেউ কেউ প্রত্যাশায় থেকে থেকে পরিবারের আকৃতি বাড়ান কিন্তু তবু হয় না প্রত্যাশিত প্রকৃতির পরিবর্তন। অথচ কন্যা বা পুত্র সন্তান জন্মদানে মানুষের কিছুই করার থাকে না। পুত্র বা কন্যাশিশু হয়ে থাকে মহান আল্লাহর ইচ্ছায়। তাই তিনি জানিয়ে দিচ্ছেন-
‘যাকে ইচ্ছা দেন কন্যা সন্তান/ করেন ইচ্ছা হলে পুত্র প্রদান।
আবার যখন এমন ইচ্ছা তাঁর হয়/ পুত্র ও কন্যা দেন একত্রে উভয়।
যাকে ইচ্ছা তিনি বন্ধ্যা করান/ সর্বজ্ঞ নিশ্চয়ই এক মহাশক্তিমান’।।
(কাব্যানুবাদ : শুরা-৪৯, ৫০)
পবিত্র কোরআনেই মহান আল্লাহ্ বলেছেন, ‘লাকাদ্ খালাক্নাল ইন্সানা ফি আহ্সানি তাক্বিম্’ অর্থাৎ ‘আমি মানুষকে সুন্দর অবয়ব দিয়ে সৃষ্টি করেছি’। তাই বলা যায়, সৃষ্টিগতভাবেই প্রত্যেক মানুষ মহান আল্লাহ্র সুন্দরতম ও শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। তারপরও মানবিক স্থূল দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা মানুষের অবয়ব, বর্ণ, আকৃতি নিয়ে নানা মন্তব্য করি। কিন্তু এতে তো মানুষের কোনো কিছু করার নেই, সবই হয় মহান আল্লাহ্র ইচ্ছায় এবং তিনি বলেন, ‘সেই মহিমান্বিত সত্তা, যিনি তোমাদের মাতৃগর্ভে গড়ে তোলেন যেমন খুশি তেমন করে’ (আল ইমরান :০৫)।
অভাব-দারিদ্র্যের চির অভ্যস্ত সংসারে নবজাতকের হাসি-কান্না অনেক সময় হয় অপ্রত্যাশিত। কিন্তু এ কথাও সত্য এবং আমাদের ঈমানের অংশ ‘রিজিকের মালিক মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন। তাই ভয়ের কী আছে? মহান আল্লাহ্ বলেন, ‘তোমরা দারিদ্র্যের ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা কর না। আমিই তাদের রিজিক দেব এবং তোমাদেরও। নিশ্চয়ই তাদের হত্যা করা মহা অন্যায়’ (বনী ইসরাইল : ৩১)।
সুতরাং যার জন্ম হওয়ার সে জন্মাবেই, এতেও রয়েছে মাহন আল্লাহ্র পরীক্ষা। কারণ, সম্পদশালী হলেই সন্তানের অধিকারী হওয়া যায় না বরং এর জন্য প্রয়োজন সার্বক্ষণিক সাধনা ও সংগ্রাম। এ জন্যই মহান আল্লাহ্র সতর্কবাণী ‘জেনে রেখ, ধন-সম্পত্তি ও সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য এক মহাপরীক্ষা’ (আনফাল : ২৮)।
সন্তান-সন্ততি মহান আল্লাহ্র বিশেষ অনুগ্রহ। চাইলেই সবাই তা পায় না, আবার না চাইতেই অনেকে লাভ করেন মহান আল্লাহর এই অনুগ্রহ। তাই প্রত্যেক সন্তানের পিতা-মাতার কর্তব্য হল সন্তানকে দেশ ও দশের প্রয়োজনের উপযোগী করে গড়ে তোলা। সন্তান-সন্ততি যেন পরিবার ও সমাজের জন্য দায় বা বোঝা না হয় সে জন্য সচেষ্ট থাকা পিতা-মাতার কর্তব্য। এটা একটি শিশুর জন্মগত অধিকার। এ জন্যই প্রিয়নবী (স.) বলেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের সম্মান কর এবং তাদের ভালো স্বভাব-চরিত্র শিক্ষা দাও’ (ইবনু মাজাহ)।
প্রিয়নবী (স.) আরও বলেন, ‘কোনো পিতা-মাতা সন্তানকে উত্তম আদব-কায়দা ও স্বভাব-চরিত্র শিক্ষাদান অপেক্ষা ভালো কোনো দান দিতে পারে না’ (তিরমিযি)।
বস্তুত একটি সংসারের পূর্ণতা নির্ভর করে সন্তানাদি লাভ ও প্রতিপালনের মাধ্যমে। প্রীতিপ্রেমের পুণ্যময় বাঁধনে তখনই ওই সংসারে বিরাজ করে স্বর্গীয় সুখ। এ জন্যই মহান আল্লাহ্ দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন, ‘হে প্রভু, তুমি আমাকে ও আমার সন্তানদের নামাজ প্রতিষ্ঠাকারী বানাও। প্রভু আমার, তুমি আমার দোয়া কবুল কর’ (ইব্রাহিম : ৪০)।
মহান আল্লাহ্ বিশ্বের সব অনাগত শিশুর সৌরভে সুরভিত করুন তাদের পিতা-মাতাকে এবং সুসন্তানের গর্বে সবাইকে করুন গর্বিত ও আনন্দিত। আমিন।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, prof.ershad92@gmail.com