রোল নম্বর ১৪!
সৈয়দ আবুল মকসুদ: কোনো দেশের দুর্নীতি দাঁড়িপাল্লা, স্কেল বা নিক্তি দিয়ে মাপার বিষয় নয়। প্যাথলজিতে রক্ত পরীক্ষা করালেও ২-৩টি ল্যাবরেটরি থেকে ২-৩ রকমের রিপোর্ট আসে। তবে কোন দেশ কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত তা নির্ভুলভাবে পরিমাপ করা না গেলেও বিভিন্ন আলামত থেকে মোটের ওপর একটা ধারণা পাওয়া যায়। ১৭৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে ১৪তম হল কী ১৩তম বা ১৫তম হল, তা কোনো বড় বিষয় নয়। ১০০-এর মধ্যে বাংলাদেশ ২৫ স্কোর করল, না ২৬ বা ২৪ করল, তাও তেমন কোনো গুরুত্ব বহন করে না। পরিষ্কার কথা হল, বাংলাদেশ একটি চরম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। বাংলাদেশ দুর্নীতির এক লীলাভূমি। বাংলাদেশে সরকারি ও আধা-সরকারি অফিসগুলোর চেয়ার-টেবিল পর্যন্ত ঘুষ খায়। দুর্নীতি কী তা দেশের যে হতভাগ্যের একটি ল্যান্ডফোন সংযোগ আছে, সে জানে। এ নগরীর কোনো প্রান্তে এক চিলতে জায়গায় যে লোকটির মাথা গোঁজার একটি ঘর আছে, সে জানে। ওয়াসার পানির লাইন আনতে গিয়ে ঘুষ দেয়ার পরও তার জীবনীশক্তি শেষ করতে হয়। বিদ্যুতের লাইন আনতে গিয়ে তার শুধু জুতার তলা ক্ষয় হয় তা-ই নয়, ক্ষয় হয় তার আয়ুও। গ্যাসের লাইন চাইলে বউয়ের অলংকার বিক্রি করে কর্মকর্তার কাছে ধরনা না দিলে ১০০ বছরেও গ্যাস আসবে না তার বাড়িতে। একটি ছোট্ট কালভার্ট তৈরির জন্য যে অর্থ বা যে গম বরাদ্দ হয়, তার অর্ধেকের বেশি চলে যায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তাদের পকেটে। সেখানে বড় বড় প্রকল্পে যে কতটা দুর্নীতি হয়, তা সাধারণ মানুষের ধারণার বাইরে। রাস্তায় ইট-সুরকির লেশমাত্র ছোঁয়া লাগেনি, প্রকল্পের পুরো টাকাটা ৩০ জুনের আগেই তুলে নিয়ে গেছে ঠিকাদার। ওই অর্থের নির্দিষ্ট ভাগ চলে যায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে।
বাংলাদেশে যে প্রতি সেকেন্ডে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয়, তা যে কোনো নাগরিক জানে। প্রতিটি জায়গায় দুর্নীতি হয়। মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে একজন ঢাকা থেকে তার বাড়িতে যাবে, ট্রেনের ৮০ টাকার টিকিট কিনতে হয় ১৫০ টাকায়। লোকটি ট্রেনে উঠে দেখে অর্ধেক আসন খালি। বিমানের অবস্থা আরও চমৎকার! কোনো দম্পতির যদি স্কুল-কলেজে পড়ার বয়সী ২/১টি ছেলেমেয়ে থাকে, সে জানে দুর্নীতি কাকে বলে। সুতরাং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) এত কষ্ট করে অংক কষে বাংলাদেশের যে রোল নম্বর ঘোষণা করেছে, তা বড় কোনো ব্যাপার নয়।
মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী বিদেশী বন্ধুদের সম্মাননা ও মেডেল দেয়া নিয়ে যে কেলেংকারি হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট কেউই আইনের আওতায় আসেনি- তার পরও বাংলাদেশ দুর্নীতিতে ১ নম্বর না হওয়ায় আমি অবাক হয়েছি। মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ নিয়ে যে বাণিজ্য হয়ে গেল- তার পর বাংলাদেশের রোল নম্বর কত হল তা কেউ ভেবে দেখবে না!
আমাদের জনবহুল গরিব দেশে চুরি-চামারি হবেই। কিন্তু তার মাত্রা কত? দেশে দুর্নীতি সহনশীলতার মাত্রা অতিক্রম করেছে। দুর্নীতি করনেওয়ালা ও দুর্নীতির প্রশ্রয়দাতা হলেন রাজনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সুতরাং দুর্নীতির এরকম প্রতিবেদন প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই তারা হাহাকার করে ওঠেন। কারণ তাদের আঁতে ঘা লাগে। বিষয়টি নিয়ে তারা আত্মসমালোচনা ও পর্যালোচনা করার প্রয়োজন মনে করেন না। তারা যদি টিআই’র এই দুর্নীতির ধারণা সূচককে সতর্কবার্তা মনে করে দুর্নীতি আরেকটু কমানোর চেষ্টা করেন, তাহলে বাংলাদেশের রোল নম্বর আরেকটু ওপরে উঠতে পারে।
দুর্নীতির পরীক্ষায় সোমালিয়া, আফগানিস্তান, কিমের কোরিয়ার রোল নম্বর কত, তা নিয়ে আমাদের আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই। কেমন সুন্দর ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড বা সুইডেন- সে গল্প শুনেও আমাদের কোনো লাভ নেই। এসব সূচক-টুচকের বিশেষ মূল্য নেই। যা প্রয়োজন তা হল দুর্নীতি কমাতে সমন্বিত উদ্যোগ। সেজন্য সরকারের সদিচ্ছার প্রকাশ দেখতে চায় মানুষ। টিআইকে দুশমন মনে করে তার কর্মকর্তাদের গালাগাল দিলে কোনো লাভ হবে না। দুর্নীতি দমন সংস্থাগুলোর ভূমিকা দুর্নীতিবান্ধব। তাদের কারণে দুর্নীতি কমছে না। দুর্নীতিবাজরা দায়মুক্তি পাচ্ছে। দুর্নীতি দমন সংস্থাগুলো যদি নির্ভয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে কাজ করত, তাহলে দেশের জেলখানাগুলো অন্য কোনো অপরাধী নয়, শুধু দুর্নীতিবাজদের দ্বারাই ভরে যেত। সুযোগ না থাকার জন্যই হোক বা যে কারণেই হোক, সাধারণ মানুষ দুর্নীতি করে না। সাধারণ মানুষ দুর্নীতির শিকার এবং দুর্নীতি থেকে তাদের দুর্ভোগ। সামগ্রিক ফলাফল হল সুশাসনের চরম অভাব। আমাদের অনুরোধ, টিআই’র এই রিপোর্ট উড়িয়ে না দিয়ে, তাচ্ছিল্য না করে বরং বিবেচনায় নিয়ে দুর্নীতি কমাতে সরকার দৃষ্টিগ্রাহ্য উদ্যোগ নেবে। তা না হলে সোমালিয়ার সমপর্যায়ে পৌঁছতে বেশি সময় লাগবে না আমাদের।
সৈয়দ আবুল মকসুদ : লেখক ও গবেষক