ভর্তি ফরমের টাকা ভাগবাটোয়ারা
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফরম বিক্রির টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিচ্ছেন এক শ্রেণীর শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী। এ ফরম বিক্রি থেকে আসা অর্থের প্রায় ৭৭ শতাংশই চলে যায় তাদের পকেটসহ অন্য খাতে। বাকি ২৩ শতাংশ অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল তহবিলে জমা হয়। কিন্তু সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী এই আয়ের কমপক্ষে ৪০ শতাংশ অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা দেয়ার কথা।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ফরম বিক্রির আয়ের টাকা মূলত ভর্তি পরীক্ষার নামে বিভিন্ন খাতে খরচ দেখানো হয়। ব্যয়ের সবচেয়ে বড় খাতই হচ্ছে পরীক্ষায় দায়িত্ব পালনের নামে সম্মানী প্রদান। আর এ কারণেই শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মোটা অংকের এ সম্মানী ভোগ করেন।
সরকারের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় দেখভাল করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এ সংস্থার সর্বোচ্চ ফোরামের (পূর্ণ কমিশন) এক সভায় বলা হয়, কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমবর্ষ (সম্মান) ভর্তি পরীক্ষার ফরম বিক্রির সম্পূর্ণ অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল তহবিলে জমা করে না। আয় থেকে ন্যূনতম ৪০ শতাংশ অর্থ জমা রাখার নির্দেশনা রয়েছে।
জানতে চাইলে, ইউজিসি চেয়ারম্যান (প্রতিমন্ত্রী) অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী বৃহস্পতিবার রাতে সেলফোনে যুগান্তরকে বলেন, ছোট ছোট কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় বাদে বেশিরভাগই এ নির্দেশনা অনুসরণ করেনি। তারা এসব অর্থ পরীক্ষার কাজ যেমন খাতা দেখা, পরীক্ষার হলে দায়িত্ব পালন, আবেদনপত্র যাচাই-বাছাই করাসহ অন্য কাজে ব্যয় করে থাকে। এসব কাজে সাধারণত শিক্ষকরা জড়িত থাকেন। এজন্য এ ব্যাপারে বেশি কঠোর হওয়া যাচ্ছে না। তবে ভবিষ্যতে বাজেট বরাদ্দকালে তাদের চাহিদার ১০ শতাংশ কম দেয়া যায় কিনা, সেটা বিবেচনা করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ইউজিসির অতিরিক্ত পরিচালক (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) ফেরদৌস জামান বলেন, ভর্তি ফরম বিক্রির আয় থেকে যে ৪০ শতাংশ অর্থ কেন্দ্রীয় তহবিলে রাখার কথা, সেটা দিয়ে সাধারণত কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও গাড়ি ক্রয়ের মতো উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয়ের জন্য উৎসাহিত করা হয়ে থাকে। এই অর্থে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেয়া হয় না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ৩১টি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ফরম বিক্রি বাবদ মোট আয় করেছে ৫৫ কোটি ১৫ লাখ ১৬ হাজার টাকা। এর মধ্যে ৪২ কোটি ৫৫ লাখ ১৪ হাজার টাকাই খরচ করা হয়েছে। তহবিলে জমা পড়েছে ১২ কোটি ৬০ লাখ ২ হাজার টাকা। এটা মোট আয়ের ২৩ শতাংশ। আর ৩১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ৭টি সরকারের নির্দেশনা মেনে নির্ধারিত অর্থ জমা দিয়েছে।
আয়ের ৪০ শতাংশের স্থলে ৩১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সবচেয়ে কম অর্থ জমা দিয়েছে বুয়েট। বিগত দুই শিক্ষাবর্ষের মধ্যে ২০১২-১৩ সেশনে তারা মাত্র ৬ শতাংশ টাকা কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা দেয়। এ সময়ে তারা ৭৪ লাখ ৭৪ হাজার টাকা ফরম বিক্রি করে আয় করেছে। আর খরচ করেছে ৭০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অবশ্য এর আগের সেশনে তারা কেন্দ্রীয় তহবিলে ২২ শতাংশ অর্থ জমা দিয়েছিল। কেন্দ্রীয় তহবিলকে ঠকানোর তালিকায় আরেক প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১২-১৩ সেশনে এই প্রতিষ্ঠানটি ৮ শতাংশ অর্থ জমা দেয়। তারা মোট আয় করেছিল ৫ কোটি ৮৫ লাখ ২৬ হাজার টাকা। জমা দিয়েছে মাত্র ৪৯ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। বাকি অর্থ গেছে সংশ্লিষ্টদের পকেটে। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি এর আগের সেশনেও আয়ের মাত্র ৯ শতাংশ অর্থ জমা দিয়েছে।
তবে এর চেয়েও কম অর্থ জমা দেয়া দুটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এরা ২০১১-১২ সেশনে যথাক্রমে ২ ও ৬ শতাংশ করে অর্থ জমা দিয়েছে। বাকি টাকা এক প্রকার লুটপাট করেছে।
তবে সরকারি নির্দেশনা মেনে কেন্দ্রীয় তহবিলে অর্থ জমা দেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ও রয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ জমা দিয়েছে জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। ওই বছর তারা ১ কোটি ৩১ লাখ ১৬ হাজার টাকা আয় করে। এর মধ্যে ৭৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা তহবিলে জমা দেয়। খরচ করে মাত্র ৫২ লাখ ৪৬ হাজার টাকা।
চলতি ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে সবচেয়ে বেশি ভর্তি ফরম বিক্রি করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথমবর্ষ (সম্মান) ভর্তির জন্য ৫ লাখ ৩৭ হাজার ৬৯৬ শিক্ষার্থী আবেদন করেছে। ফরম বিক্রি করে এদের কাছ থেকে আয় হয়েছে ১৬ কোটি ১৩ লাখ টাকা। তবে এই টাকাও ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে থাকে। এ প্রতিষ্ঠানটি ভর্তি ফরমের দাম ৩০০ টাকা করে রাখে। এর মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ১৮০ টাকা এবং সংশ্লিষ্ট কলেজ ১২০ টাকা করে নেবে। সেই হিসাবে এই অর্থের মধ্যে ৯ কোটি ৬৭ লাখ ৮৫ হাজার ২৮০ টাকা পাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বাকি ৬ কোটি ৪৫ লাখ ২৩ হাজার ৫২০ টাকা পাবে বিভিন্ন কলেজ। অভিযোগ রয়েছে, ভর্তি পরীক্ষার নানা কাজের নামে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই অর্থ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমানে লুটপাট করে থাকে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ লুটপাটের অন্যতম খাত পরীক্ষার ওএমআর (মেশিনে পাঠযোগ্য উত্তরপত্র) ফরমসহ অন্য কার্যাদি সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি আইটি সেল রয়েছে। তারপরও কখনও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আবার কখনও বুয়েটের মাধ্যমে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। এর বাইরে টেন্ডারে ওএমআর ফরম কেনার নামে নিুমানের ফরম গ্রহণ ও একাধিকবার ফরম ছাপানোর আড়ালে অর্থ লুটপাটের ঘটনাও রয়েছে।
ইউজিসির এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিগত দুই শিক্ষাবর্ষে ৩১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফরম থেকে আয় হয়েছে সাড়ে ৯৮ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ২০১১-১২ সেশনে ২৬ বা প্রায় সাড়ে ১১ কোটি এবং পরের সেশনে ১২ কোটি ৬০ লাখ বা ২৩ শতাংশ টাকা জমা দেয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ২ বছরের একটিবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি নির্দেশে অনুসরণ করেনি। উভয় বছরই তারা মাত্র ১৮ শতাংশ অর্থ জমা দিয়েছে। বাকি টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়া হয়েছে। এভাবে ২ বছরই কাক্সিক্ষত পরিমাণ অর্থ জমা দেয়নি এমন প্রতিষ্ঠান হচ্ছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়, মওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়।
তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে। সরকারের নির্দেশনা মেনে ন্যূনতম ৪০ শতাংশ অর্থ জমা দিয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস।