হালুয়াঘাটে সনদ বিহীন গারো মুক্তিযোদ্ধার নেপথ্যে কারা? প্রায় ১৩ লক্ষ টাকা আত্বসাৎ
হালুয়াঘাট (ময়মনসিংহ) প্রতিবেদক:
ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলায় গারোদেরকে ভূঁয়া মুক্তিযোদ্ধা সাজিয়ে প্রায় ১৩ লক্ষ টাকা মুক্তিযোদ্ধা ভাতা উত্তোলন করেছেন একটি অসাধু চক্র।
বিভিন্ন মিথ্যা কথার ফুলঝুঁরি সাজিয়ে উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে খেটে খাওয়া নিরীহ গারোদেরকে নকল প্রক্সি খাওয়া মুক্তিযোদ্ধা সাজানো হয়েছে। বলা হয়েছে প্রতি মাসে তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধার ভাতা দেওয়া হবে, অন্যান্য সকল সুযোগ সুবিধা তারা পাবেন। ভূয়াঁ মুক্তিযোদ্ধা সুভাস মারাক, প্রত্যুস সাংমা ও মনেস সাংমা জানান, তাদেরকে মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ভাতা উত্তোলনের কার্ড করে ব্যাংকে নিয়ে আসেন কমান্ডার আমানউল্লাহ। অতপর প্রতিজনের ৩৬ হাজার টাকা করে উত্তোলন করেন এবং তা থেকে মাত্র ৫০০ টাকা দিয়ে বিদায় করে দেন। পরে আর কোন টাকা দেননি। প্রথম কিস্তিতেই প্রতিমাসের দুই হাজার টাকা করে মোট ১৮ মাসের ৩৬ হাজার টাকা উত্তোলন করেন হালুয়াঘাট মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আমান উল্লা। এরকম ভাবে বেতকুড়ি গ্রামের সিমন মাঝি ওরফে বাবরি রিছিল (৫০), উত্তর বাঘাইতলা গ্রামের লুটিশ রংদি (৫২), ও ফরিদ রিছিল (৫৫), ৫নং গাজিরভিটা ইউনিয়নের ঝাটাপাড়া গ্রামের সেকেন ঘাগ্রা (৪৫), উত্তর খয়রাকুড়ির নেপারসন রংদি (৫৫), ১নং ভূবনকুড়া ইউনিয়নের আচকিপাড়া গ্রামের মানুয়েল স্লাল (৩৫), আমিরখাকুড়া গ্রামের পলিনুস সাংমা (৪৫), দণি খয়রাকুড়ি গ্রামের কাঠ মিস্ত্রী গনেশ সুত্রধর (৫০)।
এদের নামে নকল এবং প্রক্সি দেওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধা ভাতা উত্তোলনের কার্ড করা হয়েছে। এরা সকলে সত্যতা স্বীকার করেন। নকল মুক্তিযোদ্ধা লুটিস রংদির স্ত্রী অনলা ঘাগ্রা বলেন, আগে তুলছে, মিছা কথা কইতনা। মুক্তিযোদ্ধা পংকজ ও কমান্ডার আমানউল্লাহ তার স্বামীকে ভূঁয়া মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছেন।শুধু তাই নয়, সরেজমিনে অনুসন্ধান করলে বের হয়ে আসে নেপথ্যে চাঞ্চল্যকর সকল তথ্য। যে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধার নামে এদের ভাতা উত্তোলনের কার্ড করা হয়েছে তাঁরা সকলেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু কেউ মারা গেছেন, আবার কেউ কেউ নিঁখোজ রয়েছেন। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ও ঠিকানা ব্যবহার করে জালিয়াতির নীলনকশার সুত্রপাত করেন।
সুত্রে জানা যায়, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা উত্তর বাঘাইতলা গ্রামের ধরনী রিছিল(ভারতীয় কঃ ট্রাঃ নং ৮৮৬৪) তার স্থলে নকল মুক্তিযোদ্ধা বেতকুরি গ্রামের সুভাস মারাক, নিকুলাস মারাক(ভারতীয় কঃ ট্রাঃ নং ৮৮২৫) এর স্থলে নকল মুক্তিযোদ্ধা বেতকুড়ি গ্রামের সীমন মাঝি ওরফে বাবরি রিছিল, সুরুজ রেমা(ভারতীয় কঃ ট্রাঃ নং ৮৭৯৯) এর স্থলে উত্তর বাঘাইতলার লুটিস রংদি, কুমারগাতী গ্রামের প্রদিপ সাংমা(ভারতীয় কঃট্রাঃ নং ৯০০১) এর স্থলে উত্তর বাঘাইতলা গ্রামের ফরিদ রিছিল, সুজিত মারাক(ভারতীয় কঃট্রাঃ নং ৮৭৬১) এর স্থলে ঝাটা পাড়া গ্রামের সেকেন ঘাগ্রা ওরফে সুজিত ঘাগ্রা, লিলিস রংদি(ভারতীয় কঃ ট্রাঃ নং ৮৮৫৩) এর স্থলে উত্তর খয়রাকুড়ি গ্রামের নেপারসন রংদি, জয়রামকুড়া গ্রামের সন্তুষ মারাকের স্থলে সংড়া গ্রামের মনেষ সাংমা, ভূবনকুড়া গ্রামের তরক মানখিন ( ভারতীয় কঃট্রাঃনং ৮৯৯০) এর স্থলে পলাশতলা গ্রামের প্রত্যুষ সাংমা, ভাষনপাড়া গ্রামের টস মারাক( ভারতীয় কঃ ট্রাঃ নং ৮৯৪০) এর স্থলে আচকিপাড়া গ্রামের মানুয়েল স্নাল, ওপেন মারাক(ভারতীয় কঃট্রাঃনং ৯০০৬) এর স্থলে আমিরখাকুড়া গ্রামের পলিনুস সাংমা, নাগলা গ্রামের অবিনাস চন্দ্র দাস(ভারতীয় কঃট্রাঃ নং ৮৯১৬) এর স্থলে দনি খয়রাকুড়ি গ্রামেরগনেশ সুত্রধর কে প্রক্সি খাওয়া নকল মুক্তিযোদ্ধা সাজানো হয়েছে।
সোনালী ব্যাংক সুত্রে জানা যায়, নকল মুক্তিযোদ্ধা যথাক্রমে সুবাস মারাক, সিমন মাঝি জুলাই/১০ইং তারিখ থেকে ডিসেম্বর/১৪পর্যন্ত ব্যাংক থেকে প্রত্যেকেই ১ লক্ষ ৩৮ হাজার টাকা, লুটিস রংদি, ফরিদ রিছিল, মনেশ সাংমা, প্রত্যুস সাংমা, মানুয়েল স্নাল, পলিনুস সাংমা, গনেশ সুত্রধর এরা জুলাই/১০ইং তারিখ থেকে সেপ্টেম্বর/১৪ পর্যন্ত প্রত্যেকেই ১ লক্ষ ২৩ হাজার টাকা, সেকেন ঘাগ্রা জুলাই/১৩ইং তারিখ থেকে ৬৬ হাজার টাকা, নেপারসন রংদি রুলাই/১৩ থেকে সেপ্টেম্বর/১৪ পর্যন্ত ৫১ হাজার টাকা করে মোট ১১জন ভূঁয়া ও প্রক্সি খাওয়া মুক্তিযোদ্ধার নামে সর্বমোট ১২ ল ৫৪ হাজার টাকা সরকারী রাজস্ব খাত থেকে প্রতারনা পূর্বক উত্তোলন করেন। নকল মুক্তিযোদ্ধাদেও অভিযোগ, তাদের প্রত্যেক কে প্রথম কিস্তিতে ৫শত টাকা দেন এবং বাকি টাকা সাবেক কমান্ডার আমানউল্লাহ গ্রহন করেন। এ ঘটনায় অভিযুক্ত সাবেক কমান্ডার আমানউল্লাহর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যারা আমাকে দোষারুপ করছে, তারা মিথ্যে বলছে। প্রক্সি এবং নকল মুক্তিযোদ্ধাদের সত্যতা স্বীকার করে তিনি বলেন, এদেরকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কর্তৃক পরিচয় পত্র দেখেই মুক্তিযোদ্ধা ভাতা উত্তোলনের সুপারিশ
করেছিলাম। প্রক্সি খাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ব্যাংক থেকে নিজে টাকা উত্তোলন করেছেন এমনটি অস্বীকার করে বলেন, এ ঘটনায় অন্য কেউ জড়িত থাকতে পারে। তবে এদেরকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনিনা। অভিযুক্ত মুক্তিযোদ্ধা পংকজ জানান, আমরা সাধারন সৈনিক। ভূয়াদের বিষয়ে সাবেক কমান্ডার আমানউল্লাহ জরিত বলে তিনি ইঙ্গিত দেন।
সোনালী ব্যাংক হালুয়ঘাট শাখার ম্যানেজার মোঃ আব্দুল লতিফ জানান, আমাদেরকে উপজেলা সমাজকল্যান অফিস থেকে যাদেরকে ভাতা উত্তোলনের জন্য চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তাদেরকেই একমাত্র ভাতা উত্তোলনের সুযোগ দিয়ে থাকি। এছাড়া প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কিনা এটা সনাক্ত করার দায়িত্ব আমার নয়। শুধুমাত্র প্রকৃত একাউন্ডধারিরা টাকা উত্তোলন করছে কিনা এগুলো আমরা যথাযথ নিয়ম মেনেই করে থাকি।
এ বিষয়ে হালুয়াঘাট মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা কবিরুল ইসলাম বেগ জানান, আমি দায়িত্ব পাওয়ার পর ৩৬টি বই ভূঁয়া সন্দেহে আটক করেছিলাম।যাচাই বাছাই করে কিছুবই ছেড়ে দিয়েছি। তবে আমার কাছে এখনও ৯টি বই আটক রয়েছে। এ সকল ভূঁয়া ও প্রক্সি খাওয়া মুক্তিযোদ্ধা তৈরির পেছনে সাবেক কমান্ডার আমানউল্লাহ কে দায়ী করেছেন। ইতিমধ্যে আনুমানিক ভূঁয়া মুক্তিযোদ্ধা সাজিয়ে ৪০ লক্ষাধিক টাকা নিজের পকেটে তুলেছেন। তিনি মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আমজাত হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক আহবায়ক আব্দুল গনি, সদস্য সচিব ভদ্র ম্রং, মুক্তিযোদ্ধা সুশিল ঘাগ্রা, সুকাস স্নালসহ প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধাই নিন্দা জানান। ভদ্র ম্রং বলেন, হালুয়াঘাটে যে সমস্ত ভূঁয়া ও প্রক্সি খাওয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে তারা মুক্তিযুদ্ধেও আদর্শকে কলংকিত করেছে।
উপজেলা সমাজকল্যান কর্মকর্তা ফারজানা আনসারী জানান, কারা মুক্তিযোদ্ধার
ভাতা পাবেন, এ বিষয়টি স্থানীয় নির্বাচিত কমান্ডার সনাক্ত করে থাকেন। তিনি যাদেরকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুপারিশ করেন, তাকেই আমরা ভাতা গ্রহনের সুযোগ দিয়ে থাকি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার আব্দুল আওয়াল জানান, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নামে যারা প্রতারনাপূর্বক সরকারী টাকা উত্তোলন করেছেন তাদের বিরুদ্ধে প্রতারনার অভিযোগে মামলা দায়ের করবেন।