প্রশাসনকে দলীয়করণের বহিঃপ্রকাশ গুলশানের বৈঠক
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অংশের বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে বৈঠক করা নিয়ে তোলপাড় উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। ব্যাপকভাবে প্রশাসন দলীয়করণের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে এ ঘটনা। আর দুটি প্রধান দলই এ জন্য দায়ী বলে মন্তব্য করেছেন প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেছেন তারা।
প্রশাসনের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা জানান, গত শতকের শেষ দশকের মাঝামাঝি থেকে মূলত জনপ্রশাসনে দলীয়করণ শুরু হয়। এখন তা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। নতুন সরকার এসে আগের সরকারের সুবিধাভোগী হিসেবে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহ্নিত করে বঞ্চিত করে রাখে। পরের সরকারও একই পথ অনুসরণ করে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সময়ে বঞ্চিত (ওএসডি) কর্মকর্তারাই বেগম জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. আকবর আলি খান দ্য রিপোর্টকে বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে বৈঠক করার কথা নয়। কিন্তু এরা দেখা করেছেন কিনা, দেখা করলে কেন করেছেন—এগুলো তদন্তের মাধ্যমে জানা যাবে।
‘তবে সামগ্রিকভাবে সরকারি কর্মকাণ্ডে রাজনীতির প্রভাব বেড়ে গেছে। এটা শুধু আজকে নয়, গত দুই দশক ধরে অব্যাহতভাবে বাড়ছে। এটা খুব উদ্বেগের বিষয়। এর মাধ্যমে প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে’—বলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) চেয়ারম্যান আকবর আলি খান।
আরেক সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘ওএসডি থাকুক আর পদে থাকুক কোনো কর্মকর্তা যদি খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন তবে তা অন্যায় হয়েছে। এটা শৃঙ্খলার পরিপন্থী, সরকারি কর্মচারী বিধান অনুযায়ী তারা যেতে পারেন না, কোনো দলেরও তাদের এ্যালাউ করা উচিত নয়।’
টিআইবির (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) ট্রাস্টি বোর্ডের এ সদস্য আরও বলেন, ‘জনতার মঞ্চ থেকে প্রশাসনের এ অধঃপতন শুরু, এ মঞ্চই দলীয়করণের জন্মদাতা। এর ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ সরকার প্রশাসন দলীয়করণ করে ফেলেছে, তার ফলেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো।’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, বিষয়টি এখনো নিউজের মধ্যে আছে। সবকিছু পর্যালোচনা করে পরবর্তীতে আমরা ব্যবস্থা নেব।
তবে প্রশাসন দলীয়করণের বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি।
বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার রাতে সাবেক ও বর্তমান সচিবসহ কিছু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। কর্মকর্তাদের সবাই দীর্ঘদিন ধরে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) ও বঞ্চিত বলেও প্রকাশিত খবরে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের বৈঠকের বিষয়টি সচিবালয়ের কর্মকর্তারাও ভালোভাবে নেননি। সচিবালয়ের তিন নম্বর ভবনে বসেন একজন যুগ্মসচিব। শনিবার ফোনে তিনি বলেন, বঞ্চিত হলেই সরকারি কর্মচারীদের দলীয় প্ল্যাটফরম থাকতে হবে—এটা ঠিক নয়। পদোন্নতি, পদায়নসহ নানাভাবে আমিও বঞ্চিত, তারপরও কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি তো করছি না।
‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা-১৯৮৫ অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনীতি করার সুযোগ নেই। বিধিতে বলা হয়েছে, কোনো গণকর্মচারী প্রত্যক্ষ এমনকি পরোক্ষভাবেও রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারবেন না।’
বিগত কয়েকটি সরকারের সবাই প্রশাসনে দলীয়করণের পেছনে ইন্ধন যুগিয়েছে। দলীয়করণ রোধে কেউ পদক্ষেপ নেয়নি। দলীয়করণের চক্রে পড়ে দেশ এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা।
বৃহস্পতিবারের বৈঠকের ঘটনার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্রশাসনের বর্তমান যেসব কর্মকর্তা বৈঠক করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সার্ক শীর্ষ সম্মেলন ও মালয়েশিয়া সফরের অভিজ্ঞতা নিয়ে শুক্রবার গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।
বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের প্রশাসনে রাজনীতির প্রবণতা শুরু হয় ১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চ গঠনের মধ্য দিয়ে। তখন এ মঞ্চকে কেন্দ্র করে প্রশাসনের কর্মকর্তারা দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৯৬ সালে বিসিএস প্রশাসন এ্যাসোসিয়েশনের যারা নেতৃত্বে ছিলেন এরাই সরকারবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের একপর্যায়ে জনতার মঞ্চ প্রতিষ্ঠায় সরাসরি সহায়তা করেন। মনে করা হয়, ’৯৬-এর নির্বাচনে প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। নির্বাচনে বিএনপি হেরে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট কারচুপির অভিযোগও তুলেছিল ওই সময়।
২০০৬ সালের ২৪ নভেম্বর উত্তরায় তৎকালীন জ্বালানি উপদেষ্টা বর্তমানে কারান্তরীণ দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘আর্টিসান সিরামিক’-এ পুলিশসহ প্রশাসনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা গোপনে বৈঠক করেন। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচন (পরে বাতিল হয়) সামনে রেখে এ বৈঠক হয়েছিল বলে জানা যায়। গণমাধ্যমের কর্মীরা সেখানে গেলে বৈঠকে যোগ দেওয়া অনেক কর্মকর্তা মুখ ঢেকে ও দৌড়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। এ দৃশ্য বেসরকারি কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচার করা হয় ও বিভিন্ন সংবাদপত্রে ওই ছবি প্রকাশিত হয়। এ ঘটনায় মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাও হয়।
বিগত মহাজোট সরকারের শেষদিকে ওএসডি থাকা কর্মকর্তারা শোডাউনের চেষ্টা করেছিলেন বলে জানা গেছে। কিন্তু সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে তারা সফল হননি। প্রশাসনের ওএসডি কর্মকর্তাদের কোনো কাজ থাকে না কিন্তু নিয়মিত বেতন পেয়ে থাকেন তারা।
বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া গত ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ১২ জানুয়ারি দায়িত্ব নেয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার।