বিএনপির আন্দোলনের আগে মহানগর কমিটি অনিশ্চিত
বিএনপি কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার আগে ঢাকা মহানগর কমিটি গঠনে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এতে বেকায়দায় পড়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত মহানগর নেতারা। দলের শীর্ষ নেতারা জানুয়ারিতে সক্রিয় আন্দোলনে যাওয়ার কথা বলছেন। আর দায়িত্বপ্রাপ্ত মহানগর নেতারা শিগগিরই মহানগরের সব কমিটি ঘোষণার কথা বলছেন। তবে মহানগর থানা বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের শঙ্কা, স্থানীয় পর্যায়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে কোন্দল থাকায় কমিটি গঠন নিয়ে বিদ্রোহের আশঙ্কা রয়েছে। ফলে কমিটি ঘোষণা কঠিন হয়ে পড়বে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মহানগর বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে ‘দৃশ্যমান’ কোনো অগ্রগতি নেই। সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের জন্য দলের হাইকমান্ড থেকে নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না।
মহানগর বিএনপি নেতাদের দাবি, রাজধানীর ৫৬টি থানা ও ১০০টি ওয়ার্ড এবং বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন পুনর্গঠনের লক্ষ্যে ১৫টি টিম কাজ করছে। কিন্তু প্রশাসন সম্মেলনের জন্য কোনো থানায় একত্রিত হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে না। ফলে আলাপ-আলোচনা করে কমিটি গঠনও করা যাচ্ছে না। তবে দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সমন্বয় করে কমিটি গঠন করা হবে। এখানে বিদ্রোহের কিছু নেই।
মহানগর নেতাদের এমন দাবির সঙ্গে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার মিল খুঁজে পাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট মহল। ১৬ অক্টোবর কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় মহানগর বিএনপি নেতা আবু সাঈদ খোকনের গাড়িবহরে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। আগুন দেওয়া হয় দুটি গাড়িতে। খোকনের অভিযোগ, সরকারি দল ও পুলিশের ছত্রছায়ায় ওই হামলা চালানো হয়েছে। তবে পুলিশ বলছে, স্থানীয় বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে বিরোধের জেরে ওই হামলা হয়।
ওই ঘটনার জের ধরে ৬ ডিসেম্বর সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে খিলক্ষেত থানা বিএনপির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। তবে এর প্রতিবাদে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের সামনে ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন নেতাকর্মীরা।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের গাড়ী বহরে হামলা ও দলীয় শৃঙ্খলার অভিযোগে সোমবার খিলক্ষেত থানা যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি নুরুল হুদা মুরাদ, থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি জহির উদ্দিন বাবু, থানা জাসাসের সাধারণ সম্পাদক মাইদুল ইসলাম শিশির এবং থানা ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক শওকত উল ইসলাম সৈকতকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
শওকত উল ইসলাম সৈকত দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে এটা করা হয়েছে। আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে আমরা এর সঙ্গে জড়িত নই।’
এছাড়া দলীয় সূত্র জানায়, খিলক্ষেত থানা বিএনপি থেকে আরও কয়েক নেতা বহিষ্কার হতে পারেন।
খিলক্ষেত থানার ৯৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি শফিকুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘শাহিনুর আলম ও এস এম ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কমিটিকে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় মহানগর বিএনপির সদস্য আখতার হোসেনের যোগসাজশে স্থগিত করেছেন। আমরা এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাই।’
খিলক্ষেত থানা বিএনপির সভাপতি শাহিনুর আলম দ্য রিপোর্টকে বলেন, “খিলক্ষেত থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আখতার হোসেনের কাছ থেকে ‘আর্থিক সুবিধা’ নিয়ে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কমিটি স্থগিত করেছেন। আমরা এ সিদ্ধান্ত মানি না। এ বিষয়ে ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) কাছে লিখিত অভিযোগ দেব।”
তিনি আরও বলেন, ‘ডুমনি ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডে উনি (গয়েশ্বর চন্দ্র রায়) পকেট কমিটি দিয়েছেন। আমি থানার সভাপতি এবং হাজী ফজলুল হক কাজল সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। আমাদের না জানিয়ে উনি কমিটি দিয়েছেন। এ কারণে আমাদের কমিটির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে।’
শাহিনুর আলম অভিযোগ করেন, ‘১৬ অক্টোবর কুড়িলের ঘটনায় আমাদের জড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। অথচ আমি ওই সময় পবিত্র হজ পালনে সৌদি আরবে ছিলাম। এ ছাড়া সাধারণ সম্পাদক তার ছেলের চিকিৎসার জন্য ব্যাংককে ছিলেন। এরপরও আমরা অনুসন্ধান করে জড়িতদের তালিকা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও মির্জা আব্বাসকে দিয়েছি।’
কমিটি গঠন প্রসঙ্গে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা হিসেবে আমাকে ১০টি থানার ৫৭টি ইউনিট কমিটি পুনর্গঠন করতে হচ্ছে। কমিটি পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় কেউ বেজার হতে পারেন, কেউ খুশি হতে পারেন। তবে বড় দলে কিছুটা অভিমান থাকবেই। আশা করি, সময়ের ব্যবধানে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
১৭ অক্টোবর ক্যান্টনমেন্ট থানা বিএনপির কমিটি গঠন নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে মারামারি ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া ১৫ নভেম্বর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসের সামনেই তার শাহজাহানপুরের বাসায় মোহাম্মদপুর থানা বিএনপির দুই গ্রুপ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ওই ঘটনায় কয়েকজন আহত হন। এর জের ধরে মোহাম্মদপুর থানা যুবদল থেকে একজনকে বহিষ্কারও করা হয়।
এর আগে, ১৭ আগস্ট মোহাম্মদপুর থানা কমিটি গঠনের জন্য বৈঠক ডেকে বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের তোপের মুখে পড়েন মহানগর বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক সালাউদ্দিন আহমেদ। ওই দিন রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকার ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা মতিঝিলের ৭৪ দিলকুশায় তার অফিস (দেশ জনতা) ভাঙচুরও করেন। সে সময় মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকা থেকে বিগত জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নপ্রাপ্ত যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের ব্যক্তিগত সহকারী জাহাঙ্গীর ও গাড়িচালক কালাম নেতাকর্মীদের মারধরের শিকার হন।
সর্বশেষ ৪ ডিসেম্বর বিকেলে রাজধানীর কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে কাফরুল থানা বিএনপির এক কর্মিসভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগর কমিটির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস, বিশেষ অতিথি হিসেবে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আব্দুল আওয়াল মিন্টু, যুগ্ম-মহাসচিব বরকতউল্লাহ বুলু, ঢাকা মহানগর কমিটির সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু থানা বিএনপির নেতাদের মধ্যে ওই কর্মিসভায় সংঘর্ষ হতে পারে- এমন আশঙ্কায় তা স্থগিত করা হয়। দলীয় সূত্রে এমনটি জানা গেছে।
কর্মিসভা বাতিল প্রসঙ্গে কাফরুল থানা বিএনপির আহ্বায়ক আলী আজগর মাতব্বর দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ৪ ডিসেম্বর কাফরুল থানা বিএনপির চারটি ওয়ার্ড নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু কী কারণে তা বাতিল হলো জানি না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্লিয়ারেন্সও দেওয়া হয়েছিল। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মির্জা আব্বাস।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের থানা কমিটি নিয়ে এখনও বসা হয়নি। তবে নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের কিছু ইউনিটের কমিটি গঠন হয়েছে। থানা কমিটি গঠনেরও পরিকল্পনা আছে।’
কমিটি গঠন প্রসঙ্গে তেজগাঁও থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ার অভিযোগ করেন, ‘মহানগর কমিটি পুনর্গঠন নিয়ে দৃশ্যমান কোনো কিছুই দেখছি না। কমিটি গঠন যে প্রক্রিয়ায় হওয়ার কথা ছিল সেভাবে কাজ হচ্ছে না। একটু ছোট আকারে মতবিনিময় হয়েছে। তবে বৃহত্তর তেজগাঁও কমিটি গঠন নিয়ে খুবই গোপনীয়তা রক্ষা করা হচ্ছে। কমিটি কিভাবে ঘোষণা করা হবে, তা নীতি-নির্ধারকরাই ভাল জানেন।’ তবে কমিটি গঠন নিয়ে এখানে বিদ্রোহ হওয়ার কোনো শঙ্কা নেই বলেও জানান তিনি।
ঢাকা মহানগরের সদস্য আতিকুল ইসলাম মতিন বলেন, ‘ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) মহানগর নেতাদের এলাকায় গিয়ে কমিটি করার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু অনেকেই তা মানছেন না। তাদের কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে, তারা পকেট কমিটি বানাতে চাচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই কমিটি গঠন করা হোক। এক্ষেত্রে কোনো ত্যাগী নেতা বাদ পড়লে তা দলের জন্য মঙ্গল হবে না।’
এদিকে, মহানগরের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সম্মেলন ছাড়া কোনভাবেই কমিটি ঘোষণা করা ঠিক হবে না। এমন অনেক থানা আছে যেখানে কমিটি গঠন নিয়ে কোনো মতবিনিয়ম সভা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘মির্জা আব্বাসের এলাকা মতিঝিল, সবুজবাগ ও পল্টন এবং মহানগর নেতা এম এ কাউয়ুমের এলাকা বাড্ডা ছাড়া অন্য কোনো এলাকায় সম্মেলন ছাড়া কমিটি গঠন কঠিন হয়ে পড়বে। ৫৬টি থানার মধ্যে কোনো থানা কমিটি এখন পর্যন্ত সম্মেলন করতে পারেনি। কাফরুল থানা বিএনপি প্রস্তুতি নিলেও তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কারণ এক থানায় যদি সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি হয় তবে সকল থানায় এভাবেই করতে হবে। এ জন্য কৌশলে এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’
অন্যদিকে, ‘ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটি তৈরি করা আছে’ বলে জানিয়েছেন মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল। তিনি বলেন, ‘শিগগিরই কমিটি ঘোষণা করা হবে।’ তবে কবে ঘোষণা করা হবে তা তিনি জানাতে পারেননি।
সোহেল বলেন, ‘আমরা সবার সঙ্গে কথা বলে কমিটি তৈরি করে রেখেছি। প্রতিটি ওয়ার্ড নেতাদের সঙ্গে আলাদা আলাদা মিটিং করে কমিটি ঠিক করা হয়েছে। এখন শুধু ঘোষণা বাকি।’
‘মহানগর কমিটির ঘোষণা শিগগিরই হবে’—এমনটি জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘কমিটি গঠনে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারাই এমনটি বলছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘ডিসেম্বর মাস চলছে। এখনই আন্দোলনের প্রকৃত সময়। ১৬ ডিসেম্বর সারাদেশে একযোগে বিজয় দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরপর ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে বড় বড় সমাবেশ করা হবে। জানুয়ারিতে আন্দোলনের নতুন মাত্র যোগ হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখনও আন্দোলনে আছি। এটা আরও জোরদার করা হবে। এ কারণে ছাত্রদল ও মহানগর কমিটি পুনর্গঠন করা হচ্ছে।’
উল্লেখ্য, মির্জা আব্বাসকে আহ্বায়ক ও হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে সদস্য সচিব করে ১৮ জুলাই ঢাকা মহানগর বিএনপির নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। তাদের এক মাসের মধ্যে সকল ওয়ার্ড ও থানা কমিটি এবং দুই মাসের মধ্যে মহানগর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। কিন্তু নির্দিষ্ট ওই সময়ের মধ্যে তারা নতুন কমিটি গঠনে ব্যর্থ হন। জানুয়ারিতে সরকার পতন আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করতে মহানগর বিএনপি সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারবে নাকি কমিটি গঠন নিয়ে নিজেরাই অন্তর্কোন্দলে নিমজ্জিত হবে—এটাই এখন দেখার বিষয়।