রাজশাহীতে ‘নাশকতাকারিরা’ প্রকাশ্যে, খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ
রাজশাহীতে নাশকতা ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ পুলিশের দাবি-আসামিদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
সম্প্রতি দুই দফায় বিএনপি-জামায়াতের ১৯৫ নেতাকর্মীকে পলাতক দেখিয়ে হুলিয়া জারি করেছেন রাজশাহী মহানগর স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল। এদিকে ‘নাশকতাকারিদের’ গ্রেফতার না করায় পুলিশের ‘ভূমিকা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা।
গত দুই বছরে ২০ দলীয় জোটের নানা আন্দোলন কর্মসূচিতে উত্তপ্ত ছিল রাজশাহী। বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের সংঘর্ষ ছিল নিত্যদিনের। এর মধ্যে নগরীর শালবাগান এলাকায় উপ-পরিদর্শক (এসআই) জাহাঙ্গীরের ওপর হামলা, রানীবাজার এলাকায় শিক্ষানবিশ উপপরিদর্শক (পিএসআই) মকবুলের ওপর ককটেল নিক্ষেপ ও লোকনাথ স্কুল মোড়ে বোমা হামলায় কনস্টেবল সিদ্ধার্থ সরকার হত্যার ঘটনা দেশ জুড়ে আলোচিত হয়।
এ সব ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে বিএনপি-জামায়াতের সাড়ে তিন হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করে আড়াই শ’ মামলা করে। ইতোমধ্যে ১৫টি মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
গত বছরের ১ এপ্রিল নগরীর শালবাগান এলাকায় এসআই জাহাঙ্গীরের ওপর হামলার ঘটনায় বিস্ফোরক আইনে দায়ের মামলাসহ মোট ১২টি মামলায় ২৫ নভেম্বর ও ২ ডিসেম্বর জামায়াত-শিবিরের ১৯৫ জন নেতাকর্মীকে পলাতক দেখিয়ে হুলিয়া জারি করা হয়। ১৫ দিনের মধ্যে ওইসব আসামিদের হাজির করতে নির্দেশ দেন আদালত।
আসামিদের মধ্যে রয়েছেন- রাজশাহী মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি ডা. জাহাঙ্গীর আলম, সহ-সেক্রেটারি এমাজ উদ্দিন মণ্ডল ও সাবেক সহকারী সেক্রেটারি প্রিন্সিপাল সিদ্দিক হোসেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিবির সভাপতি আশরাফুল আলম ইমন, মহানগর ছাত্রশিবিরের সভাপতি ডা. আনোয়ারুল ইসলাম, কাটাখালি পৌর জামায়াতের আমির মাজেদুর রহমান মাজেদ, ১৩ নং ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি রবিউল ইসলাম মিলু, মহানগর যুবদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আরিফুল ইসলাম মানিক, শিবির ‘ক্যাডার’ জসিম উদ্দিন, জামায়াত নেতা আ স ম শাহীন, রাবি শিক্ষক আমিরুল ইসলাম, জাফর বাবু, সালেকিন, টাকু শাহীন, কামারুজ্জামান রাজু, অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন ওরফে কাইঠা গিয়াস, বোমা তোফা, মন্টু গোধা, মতিহার থানা জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি চিনি গিয়াস, ইতি, আশরাফুল ইসলাম ও আবু বাক্কার প্রমুখ।
এদের মধ্যে রাজশাহী মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি ডা. জাহাঙ্গীর আলম, সহ-সেক্রেটারি এমাজ উদ্দিন মণ্ডল ও রাবি শিবিরের সভাপতি আশরাফুল আলম ইমনের বিরুদ্ধে পুলিশ কনস্টেবল সিদ্ধার্থ সরকার হত্যাসহ অর্ধশতাধিক মামলা রয়েছে।
এ সব নেতাকর্মীদের মধ্যে যুবদল ‘ক্যাডার’ আরিফুল ইসলাম মানিক বর্তমানে গ্রেফতার রয়েছেন। অন্যদের মধ্যে বেশিরভাগই এখনও গোটা নগরী দাপিয়ে বেড়ালেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
এরই মধ্যে গত ১৯ নভেম্বর রাজশাহী সিটি মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের সঙ্গে দেখা করে মহানগর শিবিরের ‘পলাতক’ নেতারা। তারা এ সময় মেয়রকে সংগঠনের স্মারকগ্রন্থ উপহার দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজশাহী ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের এক কর্মকর্তা জানান, রাজশাহী মহানগর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এমাজ উদ্দিন মণ্ডল বর্তমানে কলেজে সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি নিয়মিত অফিসও করছেন।
তিনি আরও জানান, মহানগর জামায়াতের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ছিলেন। এ ছাড়া তিনি বর্তমানে হাসপাতালে অ্যানেসথেশিয়া কনসালটেন্টের দায়িত্বে রয়েছেন।
আদালতের হুলিয়া জারি হওয়া ১৩ নং ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি রবিউল ইসলাম মিলু রাজশাহী সিটি করপোরেশনের একই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। সেইসঙ্গে তিনি সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা স্থায়ী কমিটির সভাপতিও। তিনিও নিয়মিত চেম্বারে বসেন এবং সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা কাজী আমিরুল ইসলাম দ্য রিপোর্টকে জানান, ওয়ার্ড কাউন্সিলর রবিউল ইসলাম মিলুকে তিনি রবিবার সিটি করপোরেশনে দেখেছেন। এছাড়াও দুই সপ্তাহ আগে সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সভাপতিত্ব করেছেন।
রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শফিকুল হক মিলন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘পুলিশ অতি উৎসাহী হয়ে আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছে। তারা বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে।’
তিনি দাবি করেন, বিএনপি নেতাকর্মীরা সবাই জামিনে আছে। কেউ পলাতক নেই।
তবে আদালতের হুলিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় কোথাও ভুল হয়েছে।’
রাজশাহী মহানগর জামায়াতের রাজনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক আবু মোহাম্মদ সেলিম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘পুলিশ তাদের সাজানো ছক অনুযায়ী বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করছে। কে ঘটনাস্থলে থাকছে বা থাকছে না পুলিশ তা খতিয়ে দেখে না।’
আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ- ‘নাশকতাকারী’ বিএনপি-জামায়াতের চিহ্নিত কর্মীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানোর কারণে নগরীতে সহিংস ঘটনা ঘটছে। যার ফলে গত ২৫ নভেম্বর নগরীর চৌদ্দপায় এলাকায় বাসায় ফেরার পথে খুন হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শফিউল ইসলাম লিলন।
রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘পুলিশ বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ অপরাধীদের পাচ্ছে না, এটা আমি বিশ্বাস করি না। রাস্তা-ঘাটে যেমন সাংবাদিক ভাইয়েরা তাদের (আসামি) দেখেন, তেমনি আমাদের নেতাকর্মীরাও দেখতে পান। কিন্তু পুলিশকে খবর দিলে তারা (পুলিশ) আসে না।’
তিনি বলেন, ‘প্রকারান্তরে আসামিদের যদি প্রশ্রয় দেওয়া হয় তাহলে কোনোভাবেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না।’
রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ইফতেখায়ের আলম পুলিশের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘পুলিশ হত্যাসহ বিভিন্ন মামলার চিহ্নিত বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের ধরতে আমরা তৎপর, নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার অভিযান চালানো হচ্ছে। সেইসঙ্গে গোয়েন্দারাও তৎপর রয়েছে।’