‘রাজাকার আমার সর্বস্ব নিছে, সব্বনাশ করছে’
বীরাঙ্গনা কমলার জন্ম সিরাজগঞ্জ উপজেলার দোয়াতবাড়ি বিন্দুবালা গ্রামে। এখনও এই জন্মস্থানেই বসবাস তার। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে শরীর। সময়ের গহ্বরে হারিয়েছেন দেহের অবশিষ্ট শক্তিটুকু। কোনো কথা বলতে গেলেই পুরো শরীর কেঁপে ওঠে যেন ব্যর্থতায়।
তের সন্তানের জননী কমলা। একে একে চিরতরে হারিয়েছেন ১২ সন্তানকেই। কেবল বেঁচে আছেন এখন এক মেয়ে। পাহাড় সমান শোক নিয়ে বীরাঙ্গনা এই নারী এখনও বেঁচে থাকার নিরন্তর যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। বুকের মাঝে আগলে রেখেছেন দেশকে ভালো দেখার স্বপ্ন। তিনি চান বাংলাদেশে যেন শোষণ-বঞ্চনা আর দারিদ্র্য না থাকে।
দ্য রিপোর্টকে কমলা বলেন, ‘গণ্ডগোলের এত্ত বছর গেল। এহন মইর্যা যাওয়ার দিন গুনি। মইর্যা যাওয়ার আগে দ্যাশে গরিব নাই এইড্যা দেখতে চাই। তাইলে আমরা শান্তি পামু।’
স্বাধীনতা যুদ্ধের দিনগুলোর কথা জানতে চাইলে গ্লুকোমায় আক্রান্ত চোখ এবার টলমল করে ওঠে কমলার। হালকা সবুজ রঙের শাড়ির আঁচল কাঁপা হাতে তুলে কান্না লুকোনোর কিছুটা চেষ্টা করেন তিনি। এরপর বলতে থাকেন তার প্রতি যুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া পাশবিকতার বিবরণ- ‘যুদ্ধের সময় রাজাকাররা আমার ঘর পুইড়্যা দিছে। বাদশা রাজাকার পাকসেনাগোর কাছে আমারে তুইল্যা দিছে। ওই রাজাকার আমার সর্বস্ব নিছে, আমার সব্বনাশ করছে।’
স্বাধীনতার পর সিরাজগঞ্জে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। খোঁজ নেন নির্যাতিত নারীদের। সেই স্মৃতি হাতড়ে কমলা বলেন, ‘শেখ সাহেব আনগোর মাথায় হাত রাইখ্যা কইছিল তোরা দুখ্খু করিস না। দেশের জন্যই তো তোগো এ অবস্থা। তরা হাসিনা-রেহানার মতোই আমার সন্তান।’
শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ মতো কমলাসহ আরও অনেক নারীর ঠাঁই মেলে নির্যাতিত নারী আশ্রয় কেন্দ্রে। সেখানে কমলাদের দেখাশোনা করতেন ফাতেমা লোহানী ও তার স্বামী সাংবাদিক আমিনুল চৌধুরী। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থায় কমলারা হয়ে পড়েন উদ্বাস্তু। বহু খোঁজের পর দেখা মেলে কমলার স্বামীর। কমলা চিন্তা করলেন সংসার সাজাবেন নতুন করে। কিন্তু সংসারের সুখ কমলার ভাগ্যে সইল না বেশিদিন। স্বাধীনতার কয়েক বছরের মাথায় স্বামীও তাকে ছেড়ে গেলেন। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে সেখানেই ঘর করা শুরু করলেন। এরপর সন্তানদের আগলে রেখে দুঃখে-কষ্টে চলছিল কমলার দিন।
বীরাঙ্গনা এই নারী এখনও বিশ্বাস করেন শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকলে হয়ত ভাগ্যের চাকা ঘুরতে পারত। সেই আশাবাদ প্রকাশিত হয় কমলার কথায়- ‘শেখ সাহেব বাঁইচ্যা থাকলে আনগোরে কোনো অভাব অইত না। মাইনস্যের দোয়ারে দোয়ারে ঘোরা লাগত না আর।’
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সব সরকারকেই দেখেছেন কমলা। কেউ খোঁজ-খবর রাখেনি তার মতো নারীদের।
আক্ষেপ করে কমলা বলেন, ‘গণ্ডগোলের পর অনেক দলই ক্ষমতায় আইছে। তাগো (সরকারের) ভাগ্যের পরিবর্তন হইছে, কিন্তু আনগোরে কিছুই অই নাই। আমি এহন এ অভিশাপ থেইক্যা মুক্তি চাই।’