এখনও ভাসছে তেল, সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য
সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাংকার ডুবে যাওয়ায় পানিতে ভাসমান তেল অপসারণের কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। ফলে নদীর পানিতে তেল ছড়িয়ে পড়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। মিষ্টি পানি হয়ে উঠছে বিষাক্ত। জীববৈচিত্রের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই তেল। বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় এই বন এখন বিপর্যয়ের মুখে।
গতকাল মঙ্গলবার সাড়ে ৩ লাখ লিটার তেলভর্তি ওটি সাউদার্ন স্টার সেভেন ট্যাংকারটি ডুবে যায়। এতে ট্যাংকার থেকে বেরিয়ে সুন্দরবনের এই এলাকার পানিতে তেল ছড়িয়ে পড়ছে। হুমকির মুখে পড়েছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র। এখন পর্যন্ত তেল অপসারণের কোনো ব্যবস্থা হয়নি।
এদিকে ছড়িয়ে পড়া তেল অপসারণে বিশেষ ধরনের পাউডার ছিটানো হবে বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান। বুধবার তিনি সচিবালয়ে বলেন, ঘটনাস্থলের উদ্দেশে ইতোমধ্যে উদ্ধারকারী জাহাজ ‘নির্ভীক’ ও ‘প্রত্যয়’ রওনা করেছে। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম থেকে ‘কান্ডারী-১০’ও সেখানে যাচ্ছে। কুয়াশার কারণে তিনটি জাহাজের ঘটনাস্থলে পৌঁছতে দেরি হচ্ছে।
তিনি বলেন, জাহাজ থেকে বের হওয়া তেল পানির উপর থেকে দূর করতে কান্ডারী থেকে পাউডারজাতীয় পদার্থ ছিটানো হবে। এতে তেল পানির নীচে চলে যাবে।
পরিবশে ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করেন এমন গবেষকরা আশঙ্কা করছেন, নদীর জোয়ার-ভাটার কারণে এ তেল সুন্দরবনের পূর্ব-পশ্চিমেও ছড়িয়ে পড়বে বলে। ইতোমধ্যে তেল উত্তর-দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে সুন্দরবনের পরিবেশ চরম হুমকির মুখে পড়েছে।
তাদের ভাষ্যমতে, তেল ছড়িয়ে পড়ায় পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাবে। এতে অক্সিজেন সঙ্কটে পড়বে ডলফিনসহ যে কোনো জলজ প্রাণী।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত জানান, এত পরিমাণ তেল পানিতে ভেসে থাকায় উপকূলীয় প্রাণি বৈচিত্র্যের ওপর এর মারাত্মক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। সুন্দরবনের মতো শ্বাসমূলীয় বনের গাছপালা শ্বাসমূল দিয়ে অক্সিজেন নেয়। এই তেলের আস্তর জোয়ারের সময় মাটির ওপরে বিস্তৃত হলে গাছের শ্বাস-প্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত করবে। ফলে গাছ মারা যাবে।
পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (পিএফও) আমির হোসেন চৌধুরী বলেন, ডুবে যাওয়া ট্যাংকার থেকে তেল ছড়িয়ে পড়ায় বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতী ডলফিনসহ আট প্রজাতির ডলফিন ও ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য চরম হুমকির মুখে পড়েছে। মৃগমারী-নন্দবালা-আন্ধারমানিক ডলফিন অভয়াশ্রম থেকে ডলফিনের বসতি সরে যেতে পারে।
বন বিভাগ এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির জরিপ অনুযায়ী, সুন্দরবনের মংলা থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার এলাকায় আট প্রজাতির ডলফিন দেখতে পাওয়া যায়, যা বিশ্বের সবচেয়ে কম স্থানে বেশি প্রজাতির ডলফিনের বিচরণ এলাকা। ইরাবতী, বোতলনাক, গাঙ্গেয়, ইন্দো প্যাসিফিক হাম্পব্যাক, ফিনলেস পরপয়েস, প্যানট্রপিক্যাল স্পটেড ডলফিনের প্রজাতি একসঙ্গে এই এলাকাতেই দেখা যায়। এ ছাড়া বেঙ্গল টাইগারসহ বিশ্বের মহাবিপন্ন প্রজাতির ১২ থেকে ১৫ প্রজাতির প্রাণী বনের এই এলাকায় বিচরণ করে থাকে।
এ ছাড়া সুন্দরবন ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য এবং জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি। জাতিসংঘের ওই দুই সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, সুন্দরবনের ভেতর এ এলাকা দিয়ে নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ। কিন্তু ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে নৌপরিবহন অধিদপ্তর বন আইন, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, জাতিসংঘের কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি (সিবিডি), ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিশনের নিয়ম লঙ্ঘন করে বনের ভেতর দিয়ে নৌপথ চালু করে। গত ১ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে গিয়ে তিনিও নৌপথটি বন্ধের জন্য নির্দেশ দিলেও বন্ধ হয়নি।
তেলবাহী ট্যাংকার ডুবির ঘটনায় সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার এ্যান্ড এক্সামিনার ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহম্মেদকে প্রধান করে এক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অধিদফতরের স্পেশাল অফিসার মেরিন সেফটি ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট গোলাম মাঈনউদ্দিনকে কমিটির সদস্য এবং অভ্যন্তরীণ জাহাজ পরিদর্শনালয়ের পরিদর্শক মো. আবু জাফর মিয়াকে সদস্য সচিব করা হয়েছে।
কমিটিকে ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। কমিটি তদন্ত করে দুর্ঘটনার কারণ নির্ণয়, ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ, আইএসও-৭৬ এর যে সব ধারা লঙ্ঘনের কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে তা শনাক্তকরণ, দায়ী ব্যক্তি বা সংস্থাকে শনাক্তকরণ এবং ভবিষ্যতে এ ধরণের দুর্ঘটনা রোধে করণীয় বিষয়ে সুপারিশ পেশ করবে।