শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস স্মরণ :রাজাকার মুক্ত দেশ গড়ার অঙ্গীকার
আরিফ সোহেল: বীরের আত্মদান কখনই বৃথা যায় না। বুদ্ধিজীবীদের আত্মদানও বৃথা যায়নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘বীরের রক্তস্রোত’ আর ‘মায়ের অশ্রুধারা’ কখনই বিফলে যায় না। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর বলতে দ্বিধা নেই; বীরের রক্ত বৃথা যায়নি। এবং ইতিহাসের বিচারে দেশের জন্য উৎসর্গকারী প্রকৃত বীরেরা সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনেই অধিষ্ঠিত হয়েছেন। একইভাবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে রাজাকার-আলবদর-আল শামসরা। বাঙালীরা মাথা উঁচু করে মুক্ত স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে দাঁড়িয়েছি। এটাই বাঙালীর জন্য সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। আর শুরু হয়েছে রাজাকার-আলবদরদের ফাঁসীর আদেশ কার্যকর। শেষ পর্যায়ে বিচারাধীন রয়েছে অনেক রাজাকারের ফাঁসীর আদেশও। যেখানে গণজাগরণ মঞ্চ এনে দিয়েছে নতুন মাত্র। হোক বিভক্তি। কিন্তু অভিন্ন নতুনপ্রজন্ম ‘রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশ’ গড়ার স্লোগালে উজ্জীবিত-অনুপ্রাণিত-অনুরণিত। তারাও— ‘শহীদের বাংলায়, রাজাকারের ঠাঁই নাই’— ঘোষণা দিয়েছেন।
১৯৭১ সালের ৯ মাস রক্তগঙ্গা পেরিয়ে বাঙালী জাতি যখন উদয়ের ঊষালগ্নে, বিজয়ের রক্তিম সূর্য ওঠায় হওয়ার অপেক্ষায় থাকা বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে— ঠিক তখনই বাঙালী জাতির গৌরবের কৃতী সন্তানদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আল-শামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা ওই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডে তালিকা দিয়ে, গন্তব্য চিনিয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, রাজারবাগ এবং মীরপুরের বধ্যভূমিতে দেশসেরা শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাসহ জাতির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মেধাবী সন্তানকে নির্বিশেষে হত্যা করা হয়েছে। নিরস্ত্র বুদ্ধিজীবীদের হাত-পা চোখ বেঁধে গুলি করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে। জাতির বিবেক বলে পরিচিত বুদ্ধিজীবীদের এমন নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনা ইতিহাসে বিরল। বাঙালী জাতির মুক্তি সংগ্রামে যাঁরা মেধা, মনন ও লেখনীর মাধ্যমে স্বাধীনতার সংগঠকদের অনুপ্রাণিত করেছেন; পথ দেখিয়েছেন মুক্তির; সেই বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। নরঘাতক রাজাকার বাহিনী জাতিকে মেধাশূন্য করার হীনচক্রান্ত থেকেই এই জঘন্যতম ঘটনা ঘটিয়েছে। পরাজয়ের লজ্জাকর গ্লানী মেনে নিতে না পেরেই বর্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঠাণ্ডা মাথায় সুপরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
মানবেতিহাসের অন্যতম ঘৃণ্য ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞের সূচনা হয়েছে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, আর তা চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডের মধ্যদিয়ে। বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ হতে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত; রক্তস্নাত ৯ মাসে মোট ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎক, ৪২ জন আইনজীবী এবং ১৬ জন শিল্পী-সাহিত্যিককে হত্যা করা হয়েছে।
১৪ ডিসেম্বর দুঃসহ স্মৃতিঘেরা বেদনাবিধূর একটি দিন। বিজয়ের মাত্র ২ দিন আগে হায়েনারা বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশা প্রণয়ন করেছে। পাকি. হানাদার বাহিনীর হাতে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তুলে দিয়েছে জামায়াতে ইসলামীর সশস্ত্র ক্যাডার গ্রুপ কুখ্যাত আলবদর ও আল-শামস বাহিনী। পরিকল্পিতভাবে ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত তালিকা ধরে ধরে বুদ্ধিজীবীদের বাসায় হানা দেওয়া হয়েছে। সান্ধ্য আইনের সুযোগ নিয়ে রাতের আঁধারে তালিকাভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের বাসা থেকে চোখ বেঁধে রায়েরবাজার এবং মীরপুর বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরদিন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ক্ষতবিক্ষত বিকৃত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বধ্যভূমিসহ বিভিন্ন স্থানে। ১০-১৪ ডিসেম্বর যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে; তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন— ড. জি সি দেব, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দীন আহমদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, ড. গোলাম মোর্তজা, ড. মোহাম্মদ শফি, শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজউদ্দীন হোসেন, নিজামুদ্দীন আহমেদ লাডু ভাই, খন্দকার আবু তালেব, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, নাজমুল হক, আলতাফ মাহমুদ, নতুন চন্দ্র সিংহ, আর পি সাহা, আবুল খায়ের, রশীদুল হাসান, সিরাজুল হক খান, আবুল বাশার, ড. মুক্তাদির, ফজলুল মাহি, ড. সাদেক, ড. আমিনুদ্দীন, হাবিবুর রহমান, মেহেরুন্নেসা, সেলিনা পারভীন, সায়ীদুল হাসান প্রমুখ।
গোটা বাঙালী জাতি ধারাবাহিকভাবে এই দিনটি গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছে। যথাযথভাবে স্মরণ করছে দেশের শহীদ কৃতী সন্তানদের। শোকাহত বাঙালীরা ভেতরের টান থেকেই শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে ছুটে যান স্মৃতিবিজড়িত রায়েরবাজারে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, মীরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিস্তম্ভে।
একটু ভিন্ন পরিবেশেই এবার শহীদ বুদ্ধিজীবী দিসব পালনের সুযোগ পেয়েছে বাঙালীরা। জাতি এ বছর এমন একটি প্রেক্ষাপটে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করছে; যখন একাত্তরের সেই যুদ্ধাপরাধী ও বুদ্ধিজীবী হত্যার সাথে সংশ্লিষ্টদের বিচার কাজ এগিয়ে চলছে। এর মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত অনেকের বিরুদ্ধে ফাঁসীর রায় ঘোষিত হয়েছে। মানবতাবিরোধী হত্যা মামলায় দণ্ডিত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসীর দণ্ড কার্যকর হয়েছে। জামায়াতের অপর নেতা মো. কামারুজ্জামানের ফাঁসীর রায় আপিল বিভাগে বহাল রয়েছে। স্বাধীনতাকামী বাঙালী রাজাকার কামারুজ্জামানের ফাঁসী দেখার অপেক্ষায়। চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে আরও কয়েকজন রাজাকার।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেছে। একাত্তরের ঘৃণ্য-নরঘাতক মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের শীর্ষ নেতা জামায়াত আমীর মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী, মহাসচিব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং বিভিন্ন আদালতে মামলা চলছে। কারাগারে বিচারাধীন অবস্থায় মারা গেছেন জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আযম এবং সাবেক মন্ত্রী আব্দুল আলীম।
বর্তমান সরকার চলতি মেয়াদেই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন ও রায় কার্যকরের ঘোষণা দিয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর বিচার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। জাতি এখন তাদের বিরুদ্ধে রায়ের অপেক্ষায়। কখনো কখনো যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্যকরে শ্লথ গতি নানা ধূম্রজালের সৃষ্টি করছে। অনেকেই সংশয় প্রকাশ করে প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন— রাজাকারদের বিচারদের হবে তো?
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতিক