যেখানে শুয়ে আছেন সাত সূর্যসন্তান

7-birsresto (1)১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বরে সরকারি গেজেট নোটিফিকেশন অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগ ও অদম্য সাহসিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতির সেরা বীর সন্তানদেরকে শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রীয় সম্মান ও উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তাদের মধ্যে মরণোত্তর সাতজন সর্বশ্রেষ্ঠ উপাধি ‘বীরশ্রেষ্ঠ’, ৬৮ জন ‘বীর উত্তম’, ১৭৫ জন ‘বীর বিক্রম’ এবং ৪২৬ জন ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত হন।
শহীদ সাত বীরশ্রেষ্ঠরা হলেন- ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখও ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফ, সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর, সিপাহি মোহাম্মদ মোস্তফা কামালও সিপাহি মোহাম্মদ হামিদুর রহমান, নৌবাহিনীর ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমিনএবং বিমান বাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তারা রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত আছেন। তারা আমাদের গৌরবের অহঙ্কার।
বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান

01_2১৯৪২ সালের ২৯ নভেম্বর ঢাকার ১০৯ আগা সাদেক রোডের ‘মোবারক লজে’ জন্ম নেন বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান। মা সৈয়দা মোবারকুন্নেসা খাতুন। ৯ ভাই ২ বোনের মধ্যে মতিউর ষষ্ঠ। পৈতৃক নিবাস তৎকালীন ঢাকা জেলা, বর্তমান নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার রামনগর গ্রামে। বাবা আবদুস সামাদ ছিলেন কালেক্টরেট অফিসের সুপারিনটেন্ডেন্ট। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করে মতিউর চলে যান পশ্চিম পাকিস্তানে সারগোদার পাকিস্তান বিমানবাহিনী পাবলিক স্কুলে। ডিস্টিংকশনসহ মেট্রিক পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৬১ সালে বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালের জুন মাসে রিসালপুর পিএএফ কলেজ থেকে বৈমানিক হিসেবে কমিশন লাভ করেন এবং ডিউটি পাইলট হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর করাচির মৌরীপুরে জেট কনভার্সন কোর্স সমাপ্ত করে পেশোয়ারে গিয়ে জেট পাইলট হন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ফ্লাইং অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। এরপর মিগ কনভার্সন কোর্সের জন্য পুনরায় সারগোদায় যান। ১৯৬৭ সালে তিনি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি লাভ করেন। এরপর রিসালপুরে পাঠানো হয় তাকে। রিসালপুরে দুই বছর ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর হিসেবে কাজ করার পর ১৯৭০-এ করাচি বদলি হয়ে আসেন জেট ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর হয়ে।

motiur-rohaman
ঢাকার মিরপুর বুদ্ধিজীবী সমাধিক্ষেত্রে নির্মিত বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের সমাধিসৌধ
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুই মাসের ছুটিতে ঢাকায় বেড়াতে আসেন মতিউর রহমান। দেশে অবস্থানকালে ২৫ মার্চ পাকবাহিনীর হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করে মর্মাহত তিনি তখনই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে মনস্থ করেন। পাকসৈন্যরা ভৈরব আক্রমণ করলে বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইপিআর’র সঙ্গে থেকে প্রতিরোধ বুহ্য তৈরি করেন। কিন্তু আত্মীয়-স্বজনদের চাপে তাকে ফিরে যেতে হয় পশ্চিম পাকিস্তানের কর্মস্থলে। তার মন পড়ে থাকে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে আর সুযোগ খুঁজতে থাকেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের। দিনটি ছিল একাত্তরের ২০ আগস্ট। জীবনের মায়া পরিত্যাগ করে স্ত্রী মিলি রহমান এবং দুই কন্যা মাহিন মতিউর ও তুহিন মতিউরের চাইতেও বড় হয়ে ওঠে তার দেশপ্রেম। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে পাকিস্তানের করাচির মৌরীপুর বিমানঘাঁটিতে তারই অবাঙালী ছাত্র ও সহযাত্রী পাইলট অফিসার মিনহাজ রশীদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ জঙ্গি বিমান টি-৩৩ (যার ছদ্মনাম ব্লু-বার্ড ১৬৬) ছিনতাই করে পালিয়ে আসার সময় রশীদ এ ঘটনা কন্ট্রোল টাওয়ারকে জানিয়ে দিলে অপর চারটি বিমান মতিউরের বিমানকে ধাওয়া করে। এ সময় রশীদেরসঙ্গে মতিউরের ধস্তাধস্তি চলতে থাকে এবং একপর্যায়ে রশীদ ইজেক্ট সুইচ চাপলে মতিউর বিমান থেকে ছিটকে পড়েন। উড্ডয়ন উচ্চতা কম থাকায় রশীদসহ বিমানটি ভারতীয় সীমান্ত থেকে ৩৫ মাইল দূরে বিন্দা গ্রামের থাট্টায় বিধ্বস্ত হয়। মতিউরের সঙ্গে প্যারাসুট না থাকায় তিনি নিহত হন। তার মৃতদেহ ঘটনাস্থল থেকে প্রায় আধ মাইল দূরে পাওয়া যায়। সেখান থেকে করাচির মাসরুর বিমানঘাঁটির চতুর্থ শ্রেণীর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের অসীম সাহসিকতা, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের মূল্যায়নস্বরূপ তাকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করে। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর ২০০৬ সালের ২৪ জুন তাকে শত্রুভূমি পাকিস্তান থেকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় এনে স্বাধীন বাংলার মাটিতে পুনরায় সমাহিত করা হয় ঢাকার মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী সমাধিক্ষেত্রে।
বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোস্তফা কামাল

02_1১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর বর্তমান ভোলা জেলার দৌলতখান থানার পশ্চিম হাজিপুর গ্রামে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের জন্ম। বাবা হাবিবুর রহমান ছিলেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার। শৈশব থেকেই দুঃসাহসী হিসেবে খ্যাত ছিলেন বলেই হয়তো বাবার সৈনিক জীবন তাকে আকৃষ্ট করে। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়ার পর বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে ১৯৬৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে ভর্তি হন। কুমিল্লায় ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে তার পোস্টিং হয়।
১৯৭১ সালের প্রথম দিকে এই রেজিমেন্টকে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঠানো হয়। ২৫ মার্চ কালরাত্রি থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ২৭ মার্চ এ রেজিমেন্ট পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ঘিরে তিনটি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তোলে। দক্ষিণ দিক থেকে নিরাপত্তার জন্য রেজিমেন্টের ২নং প্লাটুনকে আখাউড়ার দক্ষিণে গঙ্গাসাগরের উত্তরে দরুইন গ্রামে পাঠানো হয়। এই প্লাটুনেই ছিলেন সিপাহী মোস্তফা কামাল। কর্মতৎপরতার জন্য যুদ্ধকালীন সময়ে তাকে মৌখিকভাবে ল্যান্স নায়েকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সে হিসেবে তিনি ছিলেন দশ সৈনিকের সেকশন কমান্ডার।
১৬ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে কুমিল্লা-আখাউড়া রেললাইন ধরে উত্তর দিকে এগুতে থাকে। ১৭ এপ্রিল ভোরবেলা পাকিস্তান সেনাবাহিনী দরুইন গ্রামে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর মর্টার ও আর্টিলারির গোলাবর্ষণ শুরু করলে মেজর শাফায়াত জামিল ১১ নং প্লাটুনকে দরুইন গ্রামে আগের ২নং প্লাটুনের সঙ্গে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেন। হাবিলদার মুনির ১১নং প্লাটুন নিয়ে দরুইনে পৌঁছলে সিপাহী মোস্তফা কামাল তার কাছ থেকে গুলি নিয়ে নিজ পরিখায় অবস্থান নেন। বেলা ১১টার দিকে শত্রুর গোলাবর্ষণের সঙ্গে শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টিও। সাড়ে ১১টার দিকে মোগরা বাজার ও গঙ্গাসাগরের শত্রু অবস্থান থেকেও গোলাবর্ষণ শুরু হলো এবং ১২টার দিকে পশ্চিম দিক থেকে সরাসরি আক্রমণ।

Mustofa-Kamal
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গঙ্গাসাগরে নির্মিত বীরশ্রেষ্ট মোস্তফা কামালের সমাধিসৌধ
প্রতিরক্ষার সৈন্যরা আক্রমণের তীব্রতায় বিহ্বল হয়ে পড়ে এবং মোস্তফার ক’জন সঙ্গি শহীদ হন। মোস্তফা কামাল মরিয়া হয়ে পাল্টা গুলি চালাতে থাকেন। আত্মরক্ষার জন্য অধিনায়কসহ সবাই পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেন। তার পূর্ব দিকের সৈন্যরা পেছনে নতুন অবস্থান সরে যেতে থাকে এবং মোস্তফাকে যাবার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু পুরো কোম্পানিসহ তাদের সবাইকে নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য মোস্তফা স্থানত্যাগ না করে সাহসিকতার সঙ্গে পূর্ণোদ্যমে এলএমজি থেকে গুলি চালাতে থাকেন। তার ৭০ গজের মধ্যে শত্রুপক্ষ চলে এলেও তিনি থামেননি। ফলে শত্রুরা তার সঙ্গিদের পিছু ধাওয়া করতে সাহস পায়নি। একসময় গুলি শেষ হয়ে এলে শত্রুর আঘাতে তিনি লুটিয়ে পড়েন।
বীরশ্রেষ্ঠ ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমিন

03১৯৩৫ সালে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ির বাঘচাপাড়া গ্রামে বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আজহার পাটোয়ারী, মা জোলেখা খাতুন। বাঘচাপড়া প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে আমিষাপাড়া হাই স্কুলে ভর্তি হন তিনি। সংসারের অসচ্ছলতার কারণে হাই স্কুলের পড়া শেষ করেই ১৯৫৩ সালে জুনিয়র মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পাকিস্তান নৌ-বাহিনীতে যোগ দেন। আরব সাগরে অবস্থিত মানোরা দ্বীপে পিএনএস বাহাদুরে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর পিএনএস কারসাজে যোগ দেন।
১৯৫৮ সালে পেশাগত প্রশিক্ষণ শেষ করেন এবং ১৯৬৫ সালে মেকানিসিয়ান কোর্সের জন্য নির্বাচিত হন। পিএনএস কারসাজে কোর্স সমাপ্ত করার পর আর্টিফিসার পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম পিএনএস বখতিয়ার নৌঘাঁটিতে বদলি হয়ে যান।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঘাঁটি থেকে পালিয়ে গিয়ে ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত অতিক্রম করে ২নং সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২নং সেক্টরের অধীনে থেকে বিভিন্ন স্থলযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী গঠিত হলে কলকাতায় চলে আসেন। ভারত সরকার বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে দুটো গানবোট উপহার দেয়। গানবোট দুটোর নামকরণ করা হয় ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’।

রুহুল আমিনকে পলাশের প্রধান ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

ruhul-amin
খুলনায় রূপসার তীরে বাগমারা গ্রামে নির্মিত বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের সমাধিসৌধ
৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী যশোর সেনানিবাস দখলের পর খুলনার মংলা বন্দরে পাকিস্তানি রণতরী পিএনএস তিতুমীর দখল করার উদ্দেশ্যে ১০ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে সাতটায় ‘পলাশ’ নিয়ে রুহুল আমিন মুক্তিবাহিনীর অন্য গানবোট ‘পদ্মা’ ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর গানবোট ‘পানভেল’-এর সঙ্গে মংলা বন্দরে পৌঁছান। দুপুর ১২টার দিকে গানবোটগুলো খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছাকাছি এলে অনেক উঁচুতে তিনটি পাকিস্তানি জঙ্গি বিমানউড়তে দেখা যায়। শত্রুর বিমান অনুধাবন করে পদ্মা ও পলাশ থেকে গুলি করার অনুমতি চাওয়া হয়। কিন্তু অভিযানের সর্বাধিনায়ক ক্যাপ্টেন মনেন্দ্র নাথ ভারতীয় বিমান মনে করে গুলিবর্ষণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। কিছুক্ষণ পরেই বিমানগুলো অপ্রত্যাশিতভাবে নিচে নেমে এসে আচমকা গোলাবর্ষণ শুরু করে। গোলা সরাসরি ‘পদ্মা’র ইঞ্জিনরুমে আঘাত করে ইঞ্জিন বিধ্বস্ত করে দেয়। ‘পদ্মা’র এ পরিণতিতে পলাশের অধিনায়ক লে. কমান্ডার রায় চৌধুরি নাবিকদের জাহাজ ত্যাগের নির্দেশ দিলেও ক্ষুব্ধ রুহুল আমিন বোটের ইঞ্জিন সচল রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে কামানের ক্রুদের বিমানের দিকে গুলি ছুঁড়তে বলে ইঞ্জিনরুমে ফিরে আসেন। ইতোমধ্যে শত্রুবিমানগুলো উপূর্যপুরি বোমা বর্ষণ করে পলাশের ইঞ্জিনরুম ধ্বংস করে দেয় এবং আহত হন তিনি। তবুও জাহাজ ত্যাগ না করে প্রাণপন চেষ্টা করে এ সাহসী বীর জীবনের বিনিময়ে রণতরীকে রক্ষা করা পবিত্র দায়িত্ব মনে করেছিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। অবশেষে পলাশের ধ্বংসাবশেষ পেছনে ফেলে আহত রুহুল আমিন ঝাঁপিয়ে পড়েন রূপসায়। পাড়েও এসে পৌঁছান তিনি। কিন্তু ততক্ষণে ঘৃণ্য রাজাকারের দল অপেক্ষা করছিল সেখানে। আহত এ বীর সন্তানকে তারা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে রূপসার পাড়ে। তার বিকৃত মৃতদেহ বেশ কিছুদিন সেখানে পড়ে ছিল অযত্নে অবহেলায়।
বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোহাম্মদ হামিদুর রহমান

04_1১৯৫৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন যশোর জেলা বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার খোরদা খালিশপুর গ্রামে বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ হামিদুর রহমানের জন্ম। বাবা আব্বাস আলী মণ্ডল, মা মোসাম্মাৎ কায়সুন্নেসা। প্রথমে খালিশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং পরে স্থানীয় নাইট স্কুলে সামান্য লেখাপড়া করলেও অভাবের তাড়নায় স্কুল ছেড়ে দিতে হয়। ১৯৭১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ভর্তি হলে তাকে চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নারকীয় গণহত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে অবস্থিত প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সশস্ত্র লড়াই শুরু করলে হামিদুর রহমান এ বাহিনীতে যোগ দেন।
যুদ্ধের একপর্যায়ে ১৯৭১ সালের শেষের দিকে হামিদুর রহমান ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের শ্রীমঙ্গল থানার ধলই সীমান্তের ফাঁড়ি দখল করার অভিযানে অংশ নেন। এখানে অবস্থিত সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ পাকবাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি দখল করা মুক্তিবাহিনীর জন্য খুবই জরুরি ছিল। পরিকল্পনা মতো ২৮ অক্টোবর ভোর চারটায় মুক্তিবাহিনী লক্ষ্যস্থলের কাছে পৌঁছে অবস্থান নেয়। সামনে দু’দিকে দুই প্লাটুন, পেছনে এক প্লাটুন মুক্তিসৈন্য অবস্থান নিয়ে তিন দিক থেকে অগ্রসর হতে থাকে শত্রু অভিমুখে। শত্রু অবস্থানের কাছাকাছি এলে একটি মাইন বিস্ফোরিত হয় এবং ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পাকিস্তান বাহিনীর ৩০.এ ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্টের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ বাঁধে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১২৫ মুক্তিযোদ্ধা এ যুদ্ধে অংশ নেন। পাকবাহিনীর একটি মেশিনগান-পোস্ট এমনভাবে বসানো ছিল যে একে এড়িয়ে মুক্তিবাহিনীর জন্য সামনে এগুনো ছিল অসম্ভব। মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর ওই মেশিনগানপোস্টে গ্রেনেড হামলার সিদ্ধান্ত নেয়। গ্রেনেড ছোঁড়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় হামিদুর রহমানকে। দায়িত্ব পেয়ে তিনি পাহাড়ি খালের মধ্য দিয়ে বুকে হেঁটে গ্রেনেড নিয়ে আক্রমণ শুরু করেন। দুটি গ্রেনেড সফলভাবে মেশিনগান পোস্টে আঘাত হানে, কিন্তু তার পরপরই হামিদুর রহমান গুলিবিদ্ধ হন। সে অবস্থাতেই তিনি মেশিনগানপোস্টে গিয়ে সেখানকার দুই পাকিস্তানী সৈন্যের সঙ্গে হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু করেন। এভাবে একসময় মেশিনগানপোস্টকে অকার্যকর করে দিতে সক্ষম হন। এ সুযোগে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা বিপুল উদ্যমে এগিয়ে যান এবং পাকিস্তানী শত্রুবাহিনীকে পরাস্ত করে সীমান্ত ফাঁড়িটি দখল করতে সমর্থ হন। কিন্তু হামিদুর রহমান বিজয়ের এ স্বাদ আস্বাদন করতে পারেননি। ফাঁড়ি দখলের পর মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ হামিদুর রহমানের লাশ উদ্ধার করে।

hamidur-rahaman
ঢাকার মিরপুর বুদ্ধিজীবী সমাধিক্ষেত্রে সমাহিত বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের সমাধি
হামিদুর রহমানের মৃতদেহ সীমান্তের অল্প দূরে ভারতীয় ভূখণ্ডে ত্রিপুরা রাজ্যের হাতিমেরছড়া গ্রামে স্থানীয় এক পরিবারের পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়। নিচু স্থানে অবস্থিত হওয়ায় কবরটি একসময় পানির নিচে তলিয়ে যায়।
২০০৭ সালের ২৭ অক্টোবর বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। সে অনুযায়ী ২০০৭ সালের ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ রাইফেলসের একটি দল ত্রিপুরা সীমান্তে হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ গ্রহণ করে এবং যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে কুমিল্লার বিবিরহাট সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানকে ঢাকার মিরপুর বুদ্ধিজীবী সমাধিক্ষেত্রে সমাহিত করা হয়।
বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফ

05_1১৯৪৩ সালের মে মাসে ফরিদপুর জেলার বোয়ালখালি থানা বর্তমান মধুখালী উপজেলার সালামতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ। বাবা মুন্সী মেহেদী হোসেন, মা মকিদুন্নেসা। কিশোর বয়সে পিতার আকস্মিক মৃত্যুর ফলে বেশিদূর লেখাপড়া করা সম্ভব হয়নি তার। সংসারের অভাব মোচনের তাগিদে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় ১৯৬৩ সালের ৮ মে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর) ভর্তি হন। তার রেজিস্ট্রেশন নম্বর ১৩১৮৭। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে তিনি চট্টগ্রামে ১১ নম্বর উইংয়ের কর্মরত ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করেন।
যুদ্ধে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি পার্বত্য চট্টগ্রামের মহালছড়ি জলপথ দিয়ে পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীর চলাচল প্রতিরোধের জন্য বুড়িঘাট এলাকার চিংড়ি খালের দুই পাড়ে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তোলে। মুন্সী আবদুর রউফ ছিলেন এই কোম্পানির একজন যোদ্ধা। রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি জলপথ প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে ৮ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের দুই কোম্পানি সৈন্য সাতটি স্পিডবোট ও দুটি লঞ্চে করে বুড়িঘাট দখলের জন্য অগ্রসর হয় এবং প্রতিরক্ষা বুহ্যের সামনে এসে ৩ ইঞ্চি মর্টার ও অন্যান্য ভারি অস্ত্র দিয়ে হঠাৎ গোলাবর্ষণ শুরু করে।

munshi-abdur-rouf

রাঙ্গামাটির রিজার্ভ বাজারে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে নির্মিত বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফের সমাধিসৌধ
সামান্য অস্ত্র ও ক্ষীণ লোকবল নিয়েই মুক্তিযোদ্ধারা রুখে দাঁড়ায়।শত্রুর প্রবল শক্তি ও আক্রমণের তীব্রতায় সহযোদ্ধাদের অস্ত্র নিয়ে পশ্চাদাপসারণের পরামর্শ দিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে গেলেন পরিখায় এবং মেশিনগান দিয়ে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। মেশিনগানের এই পাল্টা আক্রমণের ফলে শত্রুর স্পিডবোটগুলো ডুবে যায়, আহত হয় আরোহীরা। লঞ্চ দুটো দ্রুত পেছনে গিয়ে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয়। এরপর সেখান থেকে শুরু করে দূরপাল্লার ভারি গোলাবর্ষণ। মর্টারের ভারি গোলা এসে পড়ে আবদুর রউফের উপর, লুটিয়ে পড়েন তিনি, আর নীরব হয়ে যায় তার মেশিনগান। ততক্ষণে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে সক্ষম হন তার সঙ্গীরা।
বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ

06_1১৯৩৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি নড়াইল জেলার মহিষখোলা গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ। বাবা মোহাম্মদ আমানত শেখ, মা জেন্নাতুন্নেসা। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করে উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু কিশোর বয়সে বাবা-মাকে হারিয়ে আর লেখাপড়া হয়নি তার। সুঠাম দেহ আর সাহসী মন সম্বল করেই ১৯৫৯ সালের ১৪ মার্চ ভর্তি হন তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর)।

তার কর্মস্থল ছিল দিনাজপুর। ১৯৭০ সালে তাকে দিনাজপুর থেকে যশোরে বদলি করা হয়।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ছুটিতে নিজ গ্রামে এসে পাকবাহিনী কর্তৃক নিরীহ জনসাধারণকে হত্যার ঘটনা দেখে তিনি চাকুরিস্থলে ফিরে না গিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৭১ এর ৫ সেপ্টেম্বর যশোরের সুতিপুরে মুক্তিবাহিনীর নিজস্ব নিরাপত্তার প্রয়োজনে একটি স্থায়ী টহল বসানো হয় এবং এই নিজস্ব প্রতিরক্ষার সামনে গোয়ালহাটি গ্রামে নূর মোহাম্মদকে অধিনায়ক করে পাঁচজনের সমন্বয়ে গঠিত একটি স্ট্যান্ডিং পেট্রোল পাঠানো হয়। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে হঠাৎ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পেট্রোলটি তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। পেছনে মুক্তিযোদ্ধাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা থেকে পাল্টা গুলিবর্ষণ করা হয়। তবু পেট্রোলটি উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। একসময়ে সহযোদ্ধা সিপাহী নান্নু মিয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে নূর মোহাম্মদ নান্নু মিয়াকে কাঁধে তুলে নেন এবং হাতের এলএমজি দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে শুরু করলে শত্রুপক্ষ পেছনে সরতে বাধ্য হয়। হঠাৎ করেই শত্রুর মর্টারের একটি গোলা এসে লাগে তার ডান কাঁধে।
munshi-abdur-rouf_1যশোরের শার্শার কাশীপুরে নির্মিত বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখের সমাধিসৌধ
নূর মোহাম্মদ ধরাশায়ী হওয়ামাত্র আহত নান্নু মিয়াকে বাঁচানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। হাতের এলএমজি সহযোদ্ধা সিপাহী মোস্তফাকে দিয়ে নান্নু মিয়াকে নিয়ে যেতে বললেন এবং মোস্তফার রাইফেল চেয়ে নিলেন। যতক্ষণ না তারা নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে সক্ষম হন ততক্ষণ ওই রাইফেল দিয়ে শত্রুসৈন্য ঠেকিয়ে রাখবেন এবং শত্রুর মনোযোগ তার দিকেই কেন্দ্রীভূত করে রাখবেন। অন্য সঙ্গিরা তাকে অনুরোধ করলেন তাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তাকে বহন করে নিয়ে যেতে গেলে সবাই মারা পড়বেন এই আশঙ্কায় তিনি রণক্ষেত্র ত্যাগ করতে রাজি হলেন না। বাকিদেরকে তিনি অধিনায়কোচিত আদেশ দিলেন তাকে রেখে চলে যেতে।
শেষপর্যন্ত তাকে রেখে সন্তর্পণে সরে যেতে পারলেন বাকিরা। এদিকে, সমানে গুলি ছুড়তে লাগলেন রক্তাক্ত নূর মোহাম্মদ। একদিকে অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী, অন্যদিকে মাত্র একটি রাইফেল ও সীমিত গুলি সম্বল করে অর্ধমৃত এক সৈনিক। এ অসম অবিশ্বাস্য যুদ্ধে তিনি শত্রুপরে এমন ক্ষতিসাধন করেন যে তারা এই মৃত্যুপথযাত্রী যোদ্ধাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে বিকৃত করে চোখ দুটো উপড়ে ফেলে। পরে প্রতিরক্ষার সৈনিকরা এসে পাশের একটি ঝাড় থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করে।
বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর

07_1বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ থানার রহিমগঞ্জ গ্রামে ১৯৪৮ সালে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের জন্ম। বাবার নাম আবদুল মোতালেব হাওলাদার। মেধাবী ছাত্র জাহাঙ্গীর ১৯৬৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন এবং ১৯৬৬ সালে আইএসসি পাশ করার পর বিমান বাহিনীতে যোগদানের চেষ্টা করেন। কিন্তু চোখের অসুবিধা থাকায় ব্যর্থ হন। পরের বছর ১৯৬৭ সালে ক্যাডেট হিসেবে পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে যোগ দেন এবং ১৯৬৮ এর ২ জুন ইঞ্জিনিয়ার্স কোরে কমিশন লাভ করেন।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় তিনি পাকিস্তানে পশ্চিম কারাকোরাম এলাকায় ১৭৩ নম্বর ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটেলিয়নের ক্যাপ্টেন হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মাতৃভূমির স্বাধীনতার যুদ্ধে যোগদানের লক্ষ্যে ৩ জুলাইপাকিস্তানে আটকে পড়া আরো তিন অফিসারসহ তিনি পালিয়ে পাকিস্তানের দুর্গম এলাকা অতিক্রম করে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সীমান্তরক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে খরস্রোতা মুনাওয়ার নদী পার হয়ে দিল্লী-কলকাতা ঘুরে অবশেষে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার মেহেদীপুরে মুক্তিবাহিনীর ৭নং সেক্টরে সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যোগ দেন।
বিভিন্ন রণাঙ্গনে অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শনের কারণে তাকে রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ ঘাঁটি দখলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১০ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর, লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম, লেফটেন্যান্ট আউয়াল ও ৫০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা চাঁপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিমে বারঘরিয়া এলাকায় অবস্থান নেন। ১৪ ডিসেম্বর শীতের ভোরে মাত্র ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বারঘরিয়া এলাকা থেকে ৩/৪টি দেশী নৌকায় করে রেহাইচর এলাকা থেকে মহানন্দা নদী পার হন। নদী অতিক্রম করার পর উত্তর দিক থেকে একটি একটি করে প্রত্যেকটি শত্রু অবস্থানের দখল নিয়ে দক্ষিণে এগুতে থাকেন।
তিনি এমনভাবে আক্রমণ পরিকল্পনা করেছিলেন যেন উত্তর দিক থেকে শত্রু নিপাত করার সময় দক্ষিণ দিক থেকে শত্রু কোনকিছু আঁচ করতে না পারে। এভাবে এগুতে থাকার সময় জয় যখন প্রায় সুনিশ্চিত তখনই ঘটে বিপর্যয়। হঠাৎ বাঁধের উপর থেকে ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের ৮/১০ জন সৈনিক দৌড়ে চর এলাকায় এসে যোগ দেয়। এরপরই শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর অবিরাম ধারায় গুলিবর্ষণ। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর জীবনের পরোয়া না করে সামনে এগিয়ে যান। ঠিক সে সময়ে শত্রুর একটি গুলি এসে বিদ্ধ হয় জাহাঙ্গীরের কপালে এবং শহীদ হন তিনি। তার মরদেহ শহীদী মর্যাদায় সমাহিত করা হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানার ঐতিহাসিক গৌড়ের সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে।
captain-mohiuddin-jahangirচাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থানার ঐতিহাসিক গৌড়ের সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের সমাধি

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend