মহান বিজয় দিবস আজ
বাঙালির পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির দিন আজ। আজ ১৬ ডিসেম্বর- মহান বিজয় দিবস। শৌর্য আর বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় দিন এটি। এই দিনটি জাতিকে স্মরণ করিয়ে দেয় ১৯৭১ সালের সেই দিনকে, যেদিন সব হারানো বাঙালির প্রাণে প্রাণে ছড়িয়ে পড়েছিল স্বাধীনতার অনাবিল আনন্দ, বিজয়ের উল্লাস।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের পর ৪৩ বছর আগের এই দিনে আসে চূড়ান্ত বিজয়। যে অস্ত্র দিয়ে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী দীর্ঘ ৯ মাস ত্রিশ লাখ বাঙালিকে হত্যা করে, সম্ভ্রম কেড়ে নেয় দুই লাখ মা-বোনের, সেই অস্ত্র পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে একরাশ হতাশা ও অপমানের গ্লানি নিয়ে তারা লড়াকু বাঙালির কাছে আত্মসমর্পণ করে। বিশ্বের মানচিত্রে অভু্যদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। আত্মপরিচয়ের ঠিকানা খুঁজে পায় বাঙালি। সেই থেকে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস।
এবার রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেকটা স্বস্তিকর পরিবেশে এসেছে এই দিন। স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের কাছে স্বস্তির আরেকটি কারণ- বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসেছে দেশ। একাত্তরের শীর্ষ ঘাতকদের বিচারের রায় ঘোষিত হয়েছে। ফাঁসির রায় কার্যকরও হয়েছে একজনের। কার্যকরের অপেক্ষায় আছে আরো কয়েকজনের দণ্ড। তাই এবার উচ্চারিত হচ্ছে দ্রুত রায় কার্যকর করার দাবি। পাশাপাশি উচ্চারিত হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি। শোক আর রক্তের ঋণ শোধ করার গর্ব নিয়ে উজ্জীবিত জাতি দিবসটি পালন করবে অন্য রকম অনুভূতি নিয়ে।
বিজয় দিবসে স্বাধীনতার আনন্দে উদ্বেল কৃতজ্ঞ জাতি সশ্রদ্ধ বেদনায় স্মরণ করবে দেশের পরাধীনতার গ্লানি মোচনে প্রাণ উৎসর্গ করা বীর সন্তানদের। সারা দেশের স্মৃতিসৌধে শহীদদের উদ্দেশে নিবেদন করা হবে পুষ্পাঞ্জলি। রাজধানীসহ সারা দেশের সব প্রান্তের মানুষ অংশ নেবে নানা অনুষ্ঠানে। বঙ্গবন্ধুর বজ্রনিনাদ ৭ মার্চের ভাষণ আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জাগরণী গানে আকাশ-বাতাস হবে মুখরিত। কেন্দ্রীয়ভাবে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে জনতার ঢল নামবে।
জাতীয় নেতাদের বাণী : বিজয় দিবসের বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলায় পরিণত করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি দল-মত-নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও চেতনা বাস্তবায়নে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে অবদান রাখার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান। রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিনম্রচিত্তে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বলেন, তিনি শত জেল-জুলুম উপেক্ষা করে বাঙালিকে বিশ্বদরবারে আপন সত্তায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এ ছাড়া বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক-সমর্থকসহ সর্বস্তরের জনগণকে তিনি বিজয়ের এই দিনে শ্রদ্ধা জানান।
বিজয় দিবসের বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, জাতির পিতা অনুধাবন করেছিলেন, স্বাধীনতা অর্জন ছাড়া বাঙালি জাতির ওপর অত্যাচার, নির্যাতন ও বঞ্চনার অবসান হবে না। তাই তিনি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা দেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। মূলত সেদিন থেকেই শুরু হয় স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত অধ্যায়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। চলে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি।
শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তূপ থেকে টেনে তুলে সোনার বাংলা গড়ার সংগ্রামে নিয়োজিত, তখনই স্বাধীনতাবিরোধী-যুদ্ধাপরাধী চক্র জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করে। অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোকে ভেঙে ফেলাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। এরপর শুরু হত্যা, কু্য ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাঁর বাণীতে প্রিয় মাতৃভূমির গণতন্ত্রকে ‘বিপদমুক্ত’ করতে স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনায় বলীয়ান হয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শোষণ-বঞ্চনামুক্ত একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়েই ১৯৭১-এ এ দেশের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে দেশের অকুতোভয় বীর মুক্তি যোদ্ধারা বিজয়ী হন। তাই ১৬ ডিসেম্বর আমাদের গর্বিত এবং মহিমান্বিত বিজয় দিবস।’
কর্মসূচি
আজ সরকারি ছুটি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ কর্মসূচি নিয়েছে। এর মধ্যে আছে স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ, শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া, মিলাদ মাহফিল, আলোচনা সভা, আলোকচিত্র-চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতু্যষে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে দিবসটির সূচনা হবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে একাত্তরের শহীদদের শ্রদ্ধা জানাবেন। বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদও স্মৃতিসেৌধে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করবেন। এরপর নামবে সাধারণ মানুষের ঢল।
সকাল সাড়ে ১০টায় তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরের জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে বীর মুক্তিযোদ্ধা, সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হবে। রাষ্ট্রপতি এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও সালাম গ্রহণ করবেন। প্রধানমন্ত্রীও অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন।
জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এবং বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতেও নানা দিবসের তাত্পর্য তুলে ধরে অনুরূপ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে।
আওয়ামী লীগ : দুই দিনব্যাপী কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন, বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, বিজয় শোভাযাত্রাসহ পাকিস্তানি হানাদারদের আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক স্থানে জমায়েত, শিখা চিরন্তনে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে শ্রদ্ধা নিবেদন। বিকেলে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর অভিমুখে বিজয় মিছিল।
পরের দিন ১৭ ডিসেম্বর বিকেল ৩টায় কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দেবেন শেখ হাসিনা।
বিএনপি : জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন, সকাল ৯টায় সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মাজারে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও ফাতিহা পাঠ।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট : রাজধানীর ৯টি মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়াও সকাল ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে বের হবে বিজয় শোভাযাত্রা।
বাংলা একাডেমি : আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, একাডেমির নজরুল মঞ্চে, বিকেল ৪টায়।
শিল্পকলা একাডেমি : সংগীত ও নৃত্যশালা মিলনায়তনে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
বাংলাদেশ সাইকেল লেন বাস্তবায়ন পরিষদ : বিজয়ের লাল সবুজ পতাকা নিয়ে বিজয় সাইকেল শোভাযাত্রা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে, সকাল সাড়ে ১১টায়।
বাংলাদেশ রোইং ফেডারেশন : নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা, হাতিরঝিল লেক, দুপুর ২টায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ : টিএসসিতে উন্মুক্ত চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, সন্ধ্যা ৬টায় জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’।
মুক্তিযুদ্ধের বইমেলা : পাবলিক লাইব্রেরি প্রাঙ্গণে প্রকাশনা সংস্থা জয়তীর আয়োজনে শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বইমেলা। চলবে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত, প্রতিদিন দুপুর ২টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত।
ছায়ানট : ভবন মিলনায়তনে গণসংগীত ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর সেন্টু রায় নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘পরিচয় কোনো আছে নাকি’ প্রদর্শিত হবে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়।
বিজয় মেলা : চ্যানেল আই কার্যালয়ে আয়োজন করা হয়েছে দিনব্যাপী বিজয় মেলার। এতে চিত্রাঙ্কন, সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি ও নাটক পরিবেশনার পাশাপাশি থাকবে মুক্তিযুদ্ধের বই, আলোকচিত্র, চিত্রমালার প্রদর্শনী।
জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি
বিজয় দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠনের কর্মসূচি কয়েক দিন আগেই শুরু হয়েছে। গত রাতেও নানামাত্রিক কর্মসূচি পালন করে বিভিন্ন সংগঠন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে মহান বিজয় দিবসের ৪৩ বছর উদ&যাপন উপলক্ষে সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা ১ মিনিট পর্যন্ত ৪৩টি ফানুস উড়ানো হয়।
গণজাগরণ মঞ্চ বিকেল ৩টায় শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক উন্মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল নিষদ্ধি করার দাবি জানানো হয়।
‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ সংগঠনের শানি্তনগরে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সভায় মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্বিচারে মানুষ হত্যাকারী, নারী নির্যাতনকারী, অগ্নিসংযোগকারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানানো হয়। পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধের দায়ে সর্বোচ্চ আদালতে অভিযুক্ত মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমার সুযোগ বাতিলের দাবিও জানানো হয়।