পাকিস্তানের স্কুলে তালেবানের বর্বর হামলা, ১৩২ শিশুসহ নিহত ১৪১
পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের পেশোয়ার শহরে সেনাবাহিনী পরিচালিত এক স্কুলে নজিরবিহীন ও নৃশংস হামলা চালিয়েছে পাকিস্তানি তালেবান জঙ্গিরা। এ ঘটনায় ১৪১ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। যাদের মধ্যে অন্তত ১৩২ জনই শিশু। মৃতের তালিকায় রয়েছেন ওই স্কুলের শিক্ষকসহ আরো কর্মকর্তা কর্মচারী।
হামলা শুরুর পর শিশুদেরকে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে
এ ঘটনাকে জাতীয় দুর্যোগ ঘোষনা করে ৩ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজি শরীফ।
পেশোয়ার শেহরের সেনা কমপ্লেক্সের ঠিক পাশেই এ স্কুলটি অবস্থিত। এ স্কুলে শিক্ষার্থীরা অধিকাংশই সেনা কর্মকর্তাদের সন্তান যাদের বয়স ১৬ বা তার চেয়ে কম। স্কুলটিতে ৫ শতাধিক শিক্ষার্থী ছিলো।
স্থানীয় সময় সকাল ১০ টার দিকে স্কুলের কার্যক্রম যখন পুরোদমে চলছিলো, ঠিক তখনই স্কুলে হামলা চালায় জঙ্গিরা। কমর্কতার্রা জানান, নিরাপত্তা বাহিনীর পোষাক পরিহিত অবস্থায় অন্তত পাঁচ থেকে ছজন বন্দুকধারী এই স্কুলের দেয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করে। এসময় স্কুলে এক ফ্লোরে নবম শ্রেনীর শিক্ষার্থীদের একটি অনুষ্ঠান চলছিলো। সেখানে অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থী অবস্থান করছিলো। এর উপরে অন্য এক তলায় শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা চলছিলো। সেখানে প্রচুর সংখ্যক শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিচ্ছিলো।
স্কুলটিতে প্রবেশের পরই জঙ্গিরা নির্বিচারে শিশুদের উপর গুলি চালায়। স্কুলের একজন ল্যাব সহকারী বিবিসির কাছে বলেন, জঙ্গিরা একের পর এক ক্লাসরুমে ঢুকে শিশুদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। তাদের রুখতে ক্লাসরুমের দরজা জানালা বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু জঙ্গিরা এসব ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে এবং মাথা ও বুকে গুলি চালায়। অপর একজন নিরাপত্তাকর্মী জানান, আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম, বাচ্চারা বোধহয় দেয়ালের পাশে খেলা করছে, কিন্তু পরক্ষনেই দেখি অনেক বন্দুকধারী। হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এক শিশু বলেছে, হামলা শুরু হওয়ার পর সে এবং তার আরো ১০ সজন বন্ধু পালিয়ে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলো। কিন্তু একমাত্র সে-ই বাঁচতে পেরছে। অন্য এক শিশু বলেছে, সে বারান্দায় অনেক শিশুকে মৃত পড়ে থাকতে দেখেছে। স্থানীয় একজন মহিলা বলেছেন, তার এক বান্ধবীর মেয়ে বেঁচতে পেরছে। আশেপাশের শিশুদের রক্তে তদার জামা ভোজা দেখে জঙ্গিরা ভেবেছিলো সে মারা গেছে। তাই গুলি করেনি।
জানা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই নিহত হয় আত্মঘাতী বোমা হামলার কারনে। নিহতের মধ্যে ২ বছরের শিশু রয়েছে। এছাড়া অনেক শিশুকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে বলেও জানিয়েছে বার্তা সংস্থা সিএনএন।
তালেবান জঙ্গিরা অনেক শিশুকে জবাই করে হত্যা করেছে
দীর্ঘ গোলাগুলির পর স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৩২ মিনিটে পুলিশ ঘোষণা করে যে, অভিযান সমাপ্ত। সকল জঙ্গি নিহত হয়েছে। তবে সেনাবাহিনী বলেছে, তাদেরকে তীব্র লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। স্কুলটিতে তালেবান জঙ্গিরা প্রবেশের পর অনেকগুলো বোমা পেতেছিলো।
এখনো প্১৮০ জন আহত শিশুকে অাশপাশের হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন অধিকাংশ শিশুই মাথায় এবং বুকে মারাত্নক যখম হয়েছে।
করাচি থেকে বিসিসির সাংবাদিক সাহজেব জিলানি জানান, প্রথমে মনে করা হচ্ছিলো, তারা শিশুদেরকে জিম্মি করে রাখবো। বিনিময়ে মুক্তিপন চাইবে। কিন্তু পরে জানা গেলো, তারা প্রথম থেকেই যত বেশি সম্ভব শিশুকে হত্যা করতে চেয়েছে।
পাকিস্তানে সন্ত্রাসি হামলায় মানুষ হতাহতের ঘটনা খুবই সাধারন একটা ব্যাপার। সেখানে নিত্তনৈমত্তিকই এ ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটে। কিন্তু মঙ্গলবারের এমন নজিরবিহীন নৃশংসতা পাকিস্তানের ইতিহাসেও এক বিরল ঘটনা। ঘটনা প্রকাশ হতে শুরু হওয়ার পর শোকে স্তব্ধ হয়ে যান পাকিস্তানের মানুষ। বস্তুত ছোট ছোট এসব শিশুদের নুশংসভাবে খুন করার সংবাদে শোকস্বতব্ধ হয়ে পড়ে পুরো বিশ্ব। ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন পাকিস্তানের মানুষ। পাকিস্তনের রাজনীতিকদের প্রতিও তারা ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেন ।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতেও মানুষ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। জঙ্গিদের গুলিতে নিহত এক শিশুর বাবার বক্তব্য প্রচারিত হয়েছে স্থানীয় টিভি চ্যানেলে। তিনি বলেন, আমি আমার ছেলের দেহ পেয়েছি। এখন এটা দিয়ে আমি কি করবো? আমি আমার ছেলেকে নিয়ে অনেক সপ্ন দেখতাম। তারা আমার স্বপ্নকে গুলি করে হত্যা করেছে। তাঁর এ বক্তব্য দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে।
হামলা শুরুর পর শিশুদেরকে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে
এদিকে হামলার কয়েক মিনিটের তালেবানের পক্ষ থেকে এর বিবৃতিতে দাবি করা হয় এই হামলা তারাই চালিয়েছে এবং এটা তাদের প্রতিশোধ। তালেবানের মুখপাত্র মুহাম্মদ উমর খোরাসানি বিবৃতিতে বলেন, আমরা হামলার জন্য আর্মি স্কুল বেছে নিয়েছে। কারণ সরকার আমাদের পরিবার ও নারীদের লক্ষ্য করে অভিযান চালাচ্ছে। তিনি বলেন, হামলার মাধ্যমে আমাদের ব্যথা তাদের (সরকার) বোঝাতে চেয়েছি। এটি আমাদের প্রতিশোধ।
এ ঘটনায় শোক জানিয়ে টুইট করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এছাড়া বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য, যক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশও এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।