গোয়েন্দাদের হাতে ২০ দলীয় জোটের ‘আন্দোলনের রোডম্যাপ’ জানুয়ারিতে শুরু করে মার্চে ফসল
আগামী মার্চের মধ্যে সরকার পতন চায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। এ লক্ষ্যে আন্দোলনের নতুন রোডম্যাপ তৈরি করেছে জোটের শীর্ষ নেতৃত্ব। চূড়ান্ত আন্দোলন শুরুর জন্য ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনের বর্ষপূর্তির দিনকে বেছে নিয়েছে তারা। মিছিল-সমাবেশ ও পদযাত্রার মাধ্যমে আন্দোলন শুরুর পর ফেব্রুয়ারি থেকে হরতাল, অবরোধ, গণকারফিউ ও স্বেচ্ছায় কারাবরণের মতো কর্মসূচি দেওয়া হবে। বিএনপির নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের একাধিক নেতার সাথে কথা বলে এ সব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে সম্ভাব্য এই আন্দোলনের বিষয়ে সরকারকে সজাগ করেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। ইতোমধ্যে আন্দোলনের প্রকৃতি ও কৌশল নিয়ে পৃথক তিনটি গোয়েন্দা সংস্থার হাতে এসেছে ২০ দলীয় জোটের ‘আন্দোলনের রোডম্যাপ’। ২০ দলীয় জোটের আন্দোলনের পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশ উল্লেখ করে সরকারের কাছে প্রতিবেদন পেশ করেছে গোয়েন্দারা। সরকার পতনের আন্দোলন চাঙ্গা করতে ও দেশে অরাজকতা সৃষ্টির জন্য বিএনপি জোট নিজেদের সভা-সমাবেশে বোমা হামলা চালিয়ে প্রাণহানিসহ নানা ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করছে বলে এ সব প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বোমা হামলা করে হতাহতের ঘটনা সম্পর্কে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য আমাদের কাছে নেই। বিএনপি ওপেন পার্টি। এ দলের নেতাকর্মীরা কোনো বোমা হামলার রাজনীতি করে না। গোয়েন্দাদের এমন তথ্যের ভিত্তি নেই।’ তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্য বিএনপির সভা-সমাবেশে বোমা হামলা করে আমাদের ওপর দোষ দিতে চায়।’
আন্দোলনের বিষয়ে বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা জানান, সরকারবিরোধী আন্দোলনে গত এক বছরের ব্যর্থতা মুছে ফেলতে চায় জোটভুক্ত দলগুলো। এবার সরকার পতনই হবে আন্দোলনের একমাত্র লক্ষ্য। তবে সরকারের সঙ্গে সংলাপ ও সমঝোতার পথ উন্মুক্ত রেখেই আগামী মার্চের মধ্যে সরকারবিরোধী আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হবে।
জোটের একাধিক নেতা দ্য রিপোর্টকে জানান, আন্দোলনের কর্মসূচি ঠিক করতে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের কৌশল অনুসরণের কথা ভাবা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকাকে আন্দোলনের মূল কেন্দ্রে পরিণত করে কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড গতিশীল করতে ভেতরে ভেতরে তৎপর রয়েছেন কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগরের নেতারা।
সরকার পতনের আন্দোলনের কৌশল ঠিক করতে এরই মধ্যে দল ও জোটের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এর মধ্যে ১০ নভেম্বর বিএনপির উপদেষ্টামণ্ডলী, ১১ নভেম্বর দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও যুগ্ম মহাসচিব ও ১৩ নভেম্বর স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন খালেদা জিয়া। ২২ নভেম্বর ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন তিনি। অন্যদিকে জোটের মহাসচিবদের নিয়ে আরেকটি বৈঠক করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ ছাড়া গত কয়েক মাসে সারা দেশের বিএনপিপন্থী মেয়র, কাউন্সিলর, উপজেলা চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন দলের নেতারা। আন্দোলনের পরিকল্পনা নিয়েই সর্বশেষ বিএনপি অনুসারী সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত জোটের এক নেতার তথ্য অনুসারে, নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবি আদায়ে এবার আন্দোলনের কৌশল ও ধরন পাল্টানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে হরতাল ও অবরোধের মতো কর্মসূচি না দিয়ে কর্মী-সমর্থকদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নামানোর মতো কর্মসূচি দেওয়া। ডিসেম্বরের শেষ দিকে পদযাত্রা থেকে শুরু করে সংসদ ভবন, সচিবালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জেলা প্রসাশক কার্যালয় ও ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে চূড়ান্ত আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়া হবে। আন্দোলন চাঙ্গা রাখতে এ সব কর্মসূচিতে অংশ নেবেন খালেদা জিয়া। ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে হরতাল, অবরোধ, গণকারফিউ, স্বেচ্ছায় কারাবরণের মত কর্মসূচির ঘোষণা আসবে।
আন্দোলন সম্পর্কে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা যেখানেই যাচ্ছি জনসভাগুলোতে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আগমন ঘটছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে দেশের মানুষ রাস্তায় নামবে। জনগণই অনৈতিক, অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে এবং আন্দোলন করবে। এখন শুধু একটা আন্দোলনের অপেক্ষা। প্রতিনিয়ত জনগণের একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছি— এই সরকার সরবে কবে? আপনারা সরাবেন কবে?
এদিকে বিএনপির সম্ভাব্য আন্দোলন নিয়ে তৎপর হয়ে উঠেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এরই মধ্যে এ বিষয়ে সরকারকে সতর্ক করে প্রতিবেদন দিয়েছে তিনটি গোয়েন্দা সংস্থা। এ সব প্রতিবেদন অনুসারে, সংসদ নির্বাচনের বর্ষপূর্তির দিনকে টার্গেট করে এবং মার্চের মধ্যে সরকার পতনের লক্ষ্যে আন্দোলন পরিকল্পনা করছে বিএনপি। পরিকল্পনা অনুযায়ী, বিএনপি জোটের সঙ্গে বিভিন্ন ইসলামী দল ও জঙ্গী সংগঠনের সক্রিয় অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ঢাকাসহ দেশব্যাপী আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটাতে পারে। এ ছাড়া ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষক, উকিল, নার্স, ডাক্তার, প্রকৌশলীসহ পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের সরকারবিরোধী তৎপরতায় সক্রিয় করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আন্দোলন উত্তাল করতে জোটের সমাবেশে নিজেরাই সুপরিকল্পিত বোমা হামলার মতো অন্তর্ঘাতমূলক ঘটনার মাধ্যমে প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (গোয়েন্দা) মনিরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের আড়ালে কেউ বোমা হামলা কিংবা পরিকল্পিতভাবে কোনো নাশকতার ঘটনা ঘটাতে পারবে না। এ জন্য রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে ২০ দলীয় জোটের কর্মসূচিকে অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। ওই জোটের মধ্যে একটি রাজনৈতিক দল বিভিন্ন সময় নাশকতার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। ফলে তাদের কর্মসূচির সময় বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।