হীরার জুতা পায়ে দুদকে প্রিন্স মুসা
হীরার জুতা থেকে শুরু করে আপাদমস্তক মূল্যবান অলঙ্কারে সজ্জিত হয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জিজ্ঞাসাবাদে এসেছিলেন আলোচিত অস্ত্র ব্যবসায়ী ও ড্যাটকো গ্রুপের চেয়ারম্যান ড. মুসা বিন শমসের (প্রিন্স মুসা)।
সঙ্গে ছিল নারী-পুরুষের ৮০ জনের এক দেহরক্ষী বহর।
পশ্চিমাদের কাছে ‘বাংলাদেশের প্রিন্স’ হিসেবে পরিচিত তিনি। সম্পদশালী ধনকুবের হিসেবে বিশ্বখ্যাতি তার। ধারণা করা হয়, মুসা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ধনীদের একজন। লোকের মুখে-মুখে আছে তার বিচিত্র ও বর্ণাঢ্য জীবনের অনেক চমকপ্রদ ও চাঞ্চল্যকর ঘটনা।
জানা যায়, এ উপমহাদেশে প্রিন্স মুসা শীর্ষস্থানীয় ধর্নাঢ্য ব্যক্তি। যিনি এক বিলিয়ন পাউন্ড উপার্জন করেছেন বেশিরভাগ ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র বেচাকেনার ব্যবসা করে।
ফাইভ স্টার ফ্যামিলি : মুসার পরিবারকে বলা হয় দেশের একমাত্র ফাইভ স্টার ফ্যামিলি। কারণ তার পরিবারের সকলের কাজ, স্টাইল, আয়োজন সবই ফাইভ স্টার মানের।
মুসার কলম : এক কোটি ডলার মূল্যের মন্ট বাল্ক কলম ব্যবহার করেন তিনি। ফ্রান্সের তৈরি ওই কলম মাত্র একটিই তৈরি করেছে নির্মাতা কোম্পানি। ২২ ক্যারেট স্বর্ণের তৈরি ওই কলমটিতে রয়েছে ৭৫০০টি হীরকখণ্ড। এক কোটি ডলারের বেশি লেনদেনের ক্ষেত্রে তিনি ওই কলম ব্যবহার করেন।
বর্তমানে ওই কলমসহ সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলার সুইস ব্যাংকে আটকা রয়েছে। এ কলম ও অর্থ ফেরত পেতে পাঁচ বছর আগেই মামলা করেছেন তিনি। যে কোনো সময় ওই অর্থ ও কলম ফেরত পেতে পারেন।
মুসার ঘড়ি : মুসা যে রোলেক্স ঘড়িটি ব্যবহার করেন তার দাম ৫০ লাখ ডলার। ঘড়ির ডায়াল এবং ব্রেসলেট হীরক খচিত। কেবল তার জন্যই প্রস্তুতকৃত এই মূল্যবান ঘড়িটি তৈরি করা হয়েছিল ২৭ মাসেরও বেশি সময় ধরে। বিশ্ব বিখ্যাত রোলেক্স কোম্পানি এই ঘড়িটির প্রস্তুতকারক।
বেশভূষা, অঙ্গসজ্জা ও পানাহার : বেশভূষা ও অঙ্গসজ্জায় মুসা ব্যবহার করেন ১৬ ক্যারেটের একটি রুবি। যার দাম ১০ লাখ ডলার। ৫০ হাজার ডলার দামের একটি চুনিও পরেন তিনি। এ ছাড়াও পরেন ৫০ হাজার ডলার মূল্যের একটি হীরা ও এক লাখ ডলার মূল্যের একটি পালা (এমেরাল্ড)।
নিত্যদিনের চলাফেরায় অথবা বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে তিনি ৭০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের গহনা-অলঙ্কার পরেন। তার পরনের কয়েকটি স্যুট স্বর্ণসুতাখচিত। তাকে কখনো এক স্যুট পরিহিত অবস্থায় দুবার দেখা যায় না। প্রতিটি স্যুটের মূল্য পাঁচ থেকে ছয় হাজার পাউন্ড। প্রতিদিন তিনি গোসল করেন গোলাপ পানিতে। আর বাংলাদেশী পানি তিনি পান করেন না। বিদেশ থেকে আমদানি করা পানি তিনি পান করেন।
প্রিন্স মুসার প্রাসাদ : রাজধানীর অভিজাত গুলশান এলাকার সুরম্য প্রাসাদে মুসার বসবাস। প্রাসাদের সাজসজ্জাও চোখধাঁধানো। ঘরগুলোর মেঝে মহামূল্যবান কার্পেটে মোড়া। লিভিংরুমের আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে সুপরিসর ডাইনিং স্পেস। সব মিলিয়ে মুসার প্রাসাদটি যেন স্বপ্নপুরী।
হীরার জুতা : হীরকখচিত যে জুতা পরেন তার প্রতি জোড়ার মূল্য এক লাখ ডলার। তার সংগ্রহে রয়েছে রত্নখচিত হাজারো জুতা।
দুদকের প্রধান কার্যালয়ে আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। দুদকের সিনিয়র উপ-পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলী তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশেই প্রিন্স মুসার অর্থ-সম্পদ রয়েছে। জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তথ্য তো দূরের কথা, তার বৈধ আয় কত তা জানাই দুদকের পক্ষে দুরূহ হয়ে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কমিশন থেকে অভিযোগ অনুসন্ধানে যে সময় দেওয়া হয়, তাতে মুসার কোনো সম্পদের খোঁজই বের করা যাবে না। ন্যূনতম পাঁচ বছর লাগবে তার সম্পদের পূর্ণ হিসাব বের করতে। তবুও যদি বিদেশ থেকে তার অর্থের তথ্য পাওয়া যায় তবেই তা সম্ভব।’
এ দিকে পদ্মা সেতু নির্মাণে আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন প্রিন্স মুসা। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদক কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান।
প্রিন্স মুসা বলেন, ‘আমি অফিসিয়ালি দুদককে বলেছি, পদ্মা সেতু নির্মাণের বিভিন্ন খাতে আমি বিনিয়োগ করব।’
‘সুইস ব্যাংকে আটকে থাকা সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলার (৫১ হাজার কোটি টাকা) ফেরত পেলে তা দেশে ফিরিয়ে আনব। দেশের নির্যাতিত শিক্ষক ও অন্য শ্রেণী পেশার মানুষের কল্যাণে তা ব্যয় করব।’
দুদক সূত্র জানায়, প্রিন্স মুসার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অভিযোগ ২০১১ সালে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। তবে অজ্ঞাত কারণে দুদকের এ অনুসন্ধান আলোর মুখ দেখেনি। তিন বছর পর চলতি বছরের ‘বিজনেস এশিয়া’ ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন বিবেচনায় নিয়ে অবারও নতুন করে অনুসন্ধানে নামে দুদক। এর আগে বিজনেস ম্যাগাজিন ফোর্বসের প্রতিবেদন বিবেচনায় নিয়ে প্রিন্স মুসার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে কমিশন।
বিজনেস এশিয়া ম্যাগাজিনে মুসাকে নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশী এই ধনাঢ্য অস্ত্র ব্যবসায়ীর সাত বিলিয়ন ডলার সুইস ব্যাংকে আটকে আছে। যা বাংলাদেশী অর্থে প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকা। পদ্মা সেতু নির্মাণে তিন বিলিয়ন ডলার ব্যয় তার জন্য বেশি কিছু না বলেও উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এ উপমহাদেশে প্রিন্স মুসা শীর্ষস্থানীয় বর্ণাঢ্য ব্যক্তি যিনি এক বিলিয়ন পাউন্ড উপার্জন করেছেন বেশিরভাগ ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র বেচাকেনার ব্যবসা করে।
২০১১ সালে প্রকাশিত ফোর্বস ম্যাগাজিনে বলা হয়, মুসা বিন শমসেরই বাংলাদেশের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। তার সম্পত্তির মূল্য ১২ বিলিয়ন ইউএস ডলারের ওপরে। তিনি অস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক পরিচিত।
ড. মুসা ১৯৯৭ সালে যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে অনুদান দিতে চেয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন। লেবার পার্টির প্রার্থী টনি ব্লেয়ার নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর জন্য তার পাঁচ মিলিয়ন ডলার অনুদান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
সূত্র আরও জানায়, ২০১১ সালের ২৪ জুন মুসার যাবতীয় ব্যাংক হিসাব তলব করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দুদকের চাহিদার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুসার ব্যাংক হিসাব তলব করলেও রহস্যজনক কারণে এর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
দুদকের সিনিয়র উপ-পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলী প্রিন্স মুসার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছেন।