পে-কমিশনের রিপোর্ট ব্যাংক স্থাপন, ২০ বছরে অবসরের সুপারিশ

Govt-logo2সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কল্যাণে একটি ব্যাংক স্থাপনের সুপারিশ করেছে জাতীয় বেতন ও চাকরি কমিশন।
একই সঙ্গে কমিশন ২০ বছরে অবসর গ্রহণ, পেনশন ভাতা বৃদ্ধি, প্রেষণ না রাখা, বাসস্থান সমস্যা সমাধানে নানা সুপারিশও করেছে কমিশন।
সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে রবিবার সকালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের কাছে প্রতিবেদন তুলে দেন জাতীয় বেতন ও চাকরি কমিশনের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। প্রতিবেদন দেওয়ার আগে কমিশনের চেয়ারম্যান প্রতিবেদনের সুপারিশের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
চেয়ারম্যান বলেন, ‘বর্তমান কল্যাণ ফান্ডকে পুনর্গঠিত করে বীমা ব্যবস্থাপনা, পেনশন ফান্ড ব্যবস্থাপনা ও কল্যাণ ফান্ড ব্যবস্থাপনা এ তিন ভাগে ভাগ করে ব্যাপকভাবে ক্ষমতায়িত করা উচিত বলে মনে করে কমিশন।’
তিনি বলেন, ‘দৈনিক বাংলা মোড়ে কল্যাণ ফান্ডের যে বিরাট ভূমি খণ্ড রয়েছে, তা থেকে ২০ বা ২৫ কাঠা বিক্রি করে ৪০০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন যোগাড় করে সমৃদ্ধি সোপান ব্যাংক স্থাপনের সুপারিশ বিবেচনা করা যেতে পারে।’
মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘এ ব্যাংকটি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মালিকানায় হবে। প্রতিটি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে চার হাজার টাকা মূল্যের শেয়ার থাকবে। এটি উন্নয়ন ও বাণিজ্যিকধর্মী ব্যাংক হিসেবে কাজ করবে। পেশাদারিত্বের সঙ্গে ব্যাংকটি চালানো হবে। কমিশন মনে করে ব্যাংকটিতে নজর দিলে শুরু থেকে এক অঙ্কের সুদে সব ধরনের ঋণ দেওয়া সম্ভব হবে।’
অবসরের বয়স ২০ করতে বলেছে কমিশন
অবসরের বয়স ২৫ বছরের পরিবর্তে ২০ বছর করার কথা বলেছে বেতন কমিশন। ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘তবে বিধানটি ১৯৭৪ সালের অবসর আইনের বাইরে রাখা যায় কিনা, সে বিষয়ে সুপারিশ করেছে কমিশন।’
পেনশন ৯০ ভাগে উন্নীত করার সুপারিশ
পেনশন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘পেনশন বিষয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। পেনশনের হার শতকরা ৯০ ভাগে উন্নীত করা যায়। এটা আগে ৮০ ভাগ ছিল। তবে আনুতোষিক যেটা ২০১৩ সালের নভেম্বরে ২৬ বছর পর ১ টাকায় ২৩০ টাকা করা হয় তা আর বাড়ান সঠিক হবে না।’
ছুটি পাওয়া সাপেক্ষে পেনশনে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১২ মাসের বদলে ১৮ মাসের ছুটি নগদায়ন করা যায় কিনা, সে বিষয়ে সুপারিশ করেছে কমিশন।’
কমিশনের চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘পিআরএল (অবসরোত্তর ছুটি) ব্যবস্থা কিছু কিছু বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। তাই এলপিআর (অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটি) ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার সুপারিশ করছে কমিশন।’
কমিশনের একটি বড় সুপারিশ যে হারে বেতন বাড়ে সে হারে পেনশন বাড়ান যায় কিনা, তা সরকার বিবেচনা করে দেখতে পারে।’
‘তবে যারা বেতনের সমস্ত টাকা পেনশনের সময় নিয়ে গেছেন, তাদের চিকিৎসা ও উৎসব ভাতা বৃদ্ধি করা ছাড়া অন্য কোনো সুপারিশ করা সম্ভব হয়নি। যদিও তারা অনেক কিছু আবদার করেছেন। তাদের ওয়ান ব্যাংক ওয়ান পেনশন একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়। সম্পূর্ণ পেনশন উঠিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে পেনশন পুনরুজ্জীবনের জোর দাবির পেছনে কোনো আইনি বা নৈতিক সমর্থন আছে বলে কমিশন মনে করে না’ বলেন ফরাসউদ্দিন।
প্রেষণ না রাখার সুপারিশ
পে-কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘যেহেতু সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধি করা হচ্ছে, তাই নতুন করে ভাতা সৃষ্টির প্রয়োজন হবে না। বিদ্যমান ভাতা নির্দিষ্ট অঙ্কে অথবা হারের মধ্যে সর্বোচ্চ সীমারেখা বেঁধে দেওয়া উচিত বলে কমিশন মনে করে। প্রেষণসহ সব রকমের ভাতা বাতিল করা যেতে পারে। পাশাপাশি কমিশন ডেপুটেশন (প্রেষণ) না রাখার সুপারিশ করছে। কমিশন বিশেষ ভাতা সমর্থন করেনি। কয়েকটি ক্ষেত্রে বেতন বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ভাতার যৌক্তিককরণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।’
বাড়ি ভাড়া ভাতার ক্ষেত্রে চার ধরনের ক্যাটাগরি
বাড়ি ভাড়া ভাতা আরও যৌক্তিক করার তাগিদে তিন ধরনের ক্ষেত্রের পরিবর্তে চার ধরনের করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা, চট্টগ্রামসহ বিভাগীসহ নারায়ণগঞ্জ, কক্সবাজার, সাভার ও জেলা শহর এবং অন্যান্য এলাকার ক্ষেত্রে এ প্রস্তাব করা হচ্ছে। এতে সর্বমোট ৪টি ক্যাটাগরি রয়েছে।
গ্রাম পুলিশের কাছে সুলভ মূল্যে চাল বিক্রির সুপারিশ
চেয়ারম্যান ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘কমিশন একটি বিশেষ বিষয়ের দিকে সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ করছে। আর তা হল— গ্রাম পুলিশের স্বল্প বেতনের অর্ধেক আসে সরকারি কোষাগার থেকে। বাকিটা ইউনিয়ন কাউন্সিল দিতে পারে না। যেহেতু সংগৃহীত ধান, চাল নয় মাস পর নষ্ট হয়ে যায় এবং এখন ওপেন মার্কেট অপারেশনের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে, তাই প্রকিউরমেন্টের (কেনা) চাল অতি সুলভ মূল্যে গ্রাম পুলিশ সদস্যের কাছে ইস্যু করা যায় কিনা, তা বিবেচনা করা যেতে পারে।’
নতুন বেতন এমপিওভুক্তদের ৬ মাস পর কার্যকর
অষ্টম বেতন ও চাকরি কমিশনের সুপারিশে এমপিওভুক্তদের ক্ষেত্রে ছয় মাস পর কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘ততদিনে স্কিমটি সম্পর্কে একটি বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা ও মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়। বিশেষ করে এমপিওভুক্ত স্কুলগুলো তাদের ছাত্রদের বেতনের থেকে যে রাজস্ব আদায় করেন তার একটি অংশ সরকারকে দেওয়া যুক্তিযুক্ত মনে করে কমিশন।’
বাসস্থান সমস্যা সমাধানে নানা সুপারিশ
চেয়ারম্যান বলেন, ‘বেতন-ভাতার বাইরে সরকারি চাকরিজীবীদের বাসস্থান একটি বড় সমস্যা। এ বিষয়ে কমিশন বিভিন্ন বিকল্প সুপারিশ রেখেছে। এর একটি হল— রিয়েল এস্টেটদের মাধ্যমে সরকারের পুরনো বাড়িঘর ভেঙে অথবা খাস জমি দিয়ে ৬০ থেকে ৪০ ভাগের ভিত্তিতে আবাসনের ব্যবস্থা করা। অপর একটি বিকল্প হল— ৩০ জন বা ১০ জনের গ্রুপকে ৫ বা ১০ কাঠা জমি গৃহ নির্মাণের জন্য দেওয়া। এ ক্ষেত্রে ৫০ মাসের বেতন ব্যাংক রেটে দেওয়া যেতে পারে। অন্যথায় সাধারণভাবে জমি কেনার প্রমাণসাপেক্ষে ব্যাংক রেটে ৫০ মাসের মূল বেতন ঋণ হিসেবে দেওয়া যেতে পারে। কমিশন মনে করে, এই কার্যক্রম হাতে নিলে ম্রিয়মাণ গৃহায়ন খাতে আশার সঞ্চার হবে।’
অনুরূপভাবে গাড়ি কেনার ঋণ এক বছর নিরীক্ষামূলকভাবে প্রাধিকারপ্রাপ্তদের বাইরে তৃতীয় গ্রেড ও তার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ২৫ লাখ টাকার ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা যেতে পারে বলেও প্রতিবেদনে মতো প্রকাশ করেছে কমিশন।
কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘নিরীক্ষা সফল হলে চতুর্থ গ্রেডেও সমপরিমাণ ঋণ দেওয়া অব্যাহত রাখা যেতে পারে। তবে স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো গাড়ি ঋণ দেওয়া হলে গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের খরচ অবশ্যই সংস্থার নিজস্ব আয় থেকে বহন করার সুপারিশ করেছে কমিশন।’
স্বাস্থ্য বীমা
ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘কমপ্রিহেনসিভ বীমার ক্ষেত্রে সরকার প্রতিজন চাকরিজীবীর জন্য মাসে ৪০০ টাকা হারে সাধারণ হসপিটাইলাইজেশন, এক্সিডেন্ট এবং ১০০ টাকা লাইফ প্রিমিয়াম দিয়ে পাঁচ বছরের মেয়াদে মোট ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ, হাসপাতালের খরচসহ বীমা দাবি সরাসরি হাসপাতালে পরিশোধিত হতে পারে। কোনো ক্যাশ পেমেন্টের ব্যবস্থা থাকবে না। এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের উদ্যোগের প্রয়োজন হবে। এ ব্যবস্থা বীমা খাতেও প্রাণের জোয়ার আনবে বলে কমিশন মনে করে। এ ছাড়া বীমা খাতের উদ্বৃত্ত থেকে ৫০০ শয্যার একটি আধুনিক হৃদরোগ হাসপাতাল সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নির্মাণ করা যেতে পারে। কমিশন মনে করে বীমা প্রিমিয়াম থেকে যথেষ্ট সঞ্চয় উদ্বৃত্ত হবে। এ খাতে সরকারের খরচ শুধু প্রথম বছরেই হবে। পরবর্তী সময়ে তা অনেকটাই কমে যাবে।’
সংস্কার ভেবেচিন্তে, ক্যাডারে পিরামিড রচনা করা উচিত
ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘চাকরি বিষয়ে ব্যাপক সংস্কার ও পুনর্গঠন ভেবেচিন্তে করাই সমীচীন হবে। প্রতিটি ক্যাডারের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মান অনুসরণ করে পিরামিড রচনা করা উচিত হবে।’
তিনি বলেন, ‘পদ খালি থাকলে পদোন্নতিতে বিলম্ব এড়ানো উচিত হবে। নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের অনেক যুক্তিসঙ্গত দাবি-দাওয়া নিরীক্ষা করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।’
সচিবালয়ে কর্মচারী ও সচিবালয়ের বাইরের কর্মচারী যারা একই বেতনে ও যোগ্যতায় একসঙ্গে চাকরিতে প্রবেশ করেছিলেন, ১৯৯৫ সালে যে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিরসনের সুপারিশ করেছে কমিশন। যারা এক পদে চাকরি করে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে বাধ্য হন তাদের জন্য অর্গানোগ্রাম সৃষ্টি করা ঠিক হবে।
প্রতিটি স্তরে প্রশিক্ষণ ও বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের মাধ্যমে পদোন্নতির প্রক্রিয়াকে ঢেলে সাজাতে হবে। পদোন্নতির জন্য পরীক্ষা নেওয়ার ভীতি দূর করার সুপারিশ করেছে বেতন কমিশন।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend