বার বার ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি জামায়াত
স্বাধীনতার ৪৩ বছরে এ দেশের সকল রাজনৈতিক দলগুলোই নিজেদের স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত জামায়াতে ইসলামীকে ব্যবহার করেছে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বড় রাজনৈতিক দলগুলো যেমন জামায়াতকে ব্যবহার করেছে, অন্যদিকে জামায়াতও টিকে থাকার জন্য একেক সময় একেক দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে।
তাই দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি কখনো জামায়াতের বিরোধিতা আবার কখনো নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে জামায়াতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
জানা গেছে, স্বাধীনতার কিছুদিন পর ১৯৭২ সালেই জামায়াতে ইসলামী তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করে। ওই সময়ে সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল খালেককে আমীর নির্বাচিত করেই স্বাধীন বাংলাদেশে কাজ শুরু করে জামায়াতে ইসলামী। এরপর বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তান সফরের পর ১৯৭৪ সালে হাজার হাজার বাঙালী বাংলাদেশে ফিরে আসে। এদের মধ্যে ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর আব্দুর রহিম। তিনি ফিরে আসায় জামায়াতের নেতারা প্রাণ ফিরে পায়। এর আগে বঙ্গবন্ধুর ১৯৭৩ সালের ১৬ মে অনুকম্পা ও ৩০ নভেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগায় দলটি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে রাজনৈতিক দলবিধির আওতায় (পিপিআর) ঘরোয়া রাজনীতির জন্য আবেদন করেছিল ৯১টি রাজনৈতিক দল। তাদের মধ্যে জামায়াত ছিল। কিন্তু জামায়াত অনুমতি না পেলেও অনুমতি পায় মুসলিম লীগ। তবে জামায়াত ও নেজামে ইসলামী পার্টি মিলে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ তৈরি করে অনুমতি নিয়ে কাজ শুরু করে। ১৯৭৭ সালের ২৩ এপ্রিল সামরিক ফরমান জারি করে ধর্মনিরপেক্ষতার অবসান ঘটান জিয়াউর রহমান। এতে জামায়াতের দল গঠনের জন্য আদর্শিকভাবে দরজা খুলে যায়। তবে এর আগে ১৯৭৬ সালের মার্চে তৎকালীন উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এম জি তোয়াবের নেতৃত্বে ইসলামী জলসার নামে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামপন্থীদের সমাবেশের মাধ্যমে শক্তি প্রদর্শন করে জামায়াত। জামায়াতে ইসলামীর এই ভূমিকাই ১৯৭৮ সালের ১৮ নভেম্বরে জারি করা রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ (দ্য পলিটিক্যাল পার্টিজ অর্ডিন্যান্স ১৯৭৮)-এর ৩ ও ৪ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে রাজনীতি করার অনুমতি লাভ করে। আর ১৯৭৯ সালের ২৫-২৭ মে প্রকাশ্যে সম্মেলনের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে দল হিসেবে পুনরায় আবির্ভূত হয়।
এরপর আর জামায়াতে ইসলামীকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর সামরিক শাসক এরশাদও প্রত্যক্ষ মদদ দেন জামায়াতে ইসলামীকে। ১৯৮৬ সালে এরশাদের নির্বাচন অন্যান্য দল বর্জন করলেও আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন করে স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো নির্বাচন করার সুযোগ পায় জামায়াত।
এরপর ১৯৯৪ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলন এক মঞ্চে অবস্থান গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও বাম দলগুলো।
এ ছাড়া ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে সুপ্রীম কোর্ট যখন সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে তখন আপনা-আপনি যে সংবিধান বহাল হয়ে যায়, তাতে অনুচ্ছেদ ১২ এবং অনুচ্ছেদ ৩৮ দুই ছিল। (১৯৭২ সালের সংবিধানে দুই ধারা অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামী রাজনীতি করতে পারবে না)। এই দুই ধারা দলগতভাবে জামায়াতে ইসলামীকে বেআইনি করে তোলে। বিশেষ করে ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনে দলের দেওয়া গঠনতন্ত্র যেভাবে জামায়াতে ইসলামীর বর্ণনা দিয়েছিল তা ছিল ১৯৭২ সালের সংবিধানের পরিপন্থী। কিন্তু ২০১১ সালের জুন মাসে পঞ্চদশ সংশোধনী ৩৮ অনুচ্ছেদকে সংবিধানে পুনঃস্থাপিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরও ধর্মভিত্তিক দল গঠনে কোনো রকম বাধা-নিষেধ আরোপ না করার মধ্য দিয়ে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলগুলো আরেক দফা আইনি বৈধতা লাভ করে।
সর্বশেষ গত ৪ আগস্ট মিরপুর বোতলজাত পানি উদ্বোধন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘জামায়াত নিষিদ্ধে তাদের কোনো পরিকল্পনা নেই।’
ক্ষমতায় যেতে বিএনপির জামায়াতের সঙ্গে জোট করা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বিএনপি মুক্তিযোদ্ধার দল। মহান স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান দেশের এই জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলটি গড়েছেন। এ দলটিতেই দেশের সিংহভাগ বীর মুক্তিযোদ্ধারা আছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে বিএনপি বিশ্বাস করে না। একই সঙ্গে অন্যদের মতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে ব্যবসাও করে না। এ চেতনা বিএনপি, বিএনপির প্রতিটি নেতাকর্মী যেমন বিশ্বাস করেন, তেমনি ধারণও করেন।’
ফখরুল বলেন, ‘আওয়ামী লীগ জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ৮৬ সালে স্বৈরাচার এরশাদের অধীনে নির্বাচনে গিয়েছে। ৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে এরাই জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে আন্দোলনে গিয়েছে। শেখ হাসিনা তার আগের সরকারে রাজাকারকে মন্ত্রী বানিয়েছেন। এখনো তার মন্ত্রিসভায় রাজাকারদের স্থান দিয়েছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ করলে এ সব নিয়ে কোনো বিতর্ক হয় না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াত থাকলে জায়েজ। অন্যদের সঙ্গে থাকলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গেল বলে স্লোগান উঠে। কিন্তু দেশের মানুষ এত বোকা নন, তারা সচেতন। আওয়ামী লীগের এ সব প্রতারণা মানুষ বিশ্বাস করে না।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এভাবেই সকল সরকার (বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগ) প্রত্যক্ষভাবে জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিসর্জন দিয়ে নিজেদের স্বার্থে দীর্ঘদিন ধরে জামায়াতে ইসলামীকে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো ব্যবহার করে আসছে বলে অভিমত প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চক্রবর্তী। তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘দেশের অনেক রাজনৈতিক দল মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বললেও স্বাধীনতা যুদ্ধে দলগতভাবে বিতর্কিত জামায়াতে ইসলামীকে ব্যবহার করে আসছে।’
তিনি বলেন, ‘এটা যেমন বিএনপির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তেমনি আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।’
ড. গোবিন্দ বলেন, ‘এটা সত্যি বিএনপি জামায়াতকে এ দেশে রাজনীতি করার প্রথম সুযোগ করে দেয়। এর ধারাবাহিকতায় জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগও নিজেদের প্রয়োজনে জামায়াতের সঙ্গে অতীতে আঁতাত করেছে। একসঙ্গে রাজনীতিও করেছে। এমনকি তাদের সরকারে জামায়াতের বিতর্কিত লোকদের ক্ষমতার অংশীদার হিসেবে মন্ত্রীও করেছে।
আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের পর জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর জিয়াউর রহমান জামায়াতকে পুনঃজীবন দান করেন। আর খালেদা জিয়া তার মন্ত্রিসভায় দু’জনকে মন্ত্রী বানিয়ে জামায়াতকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘দেরিতে হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু ও ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। খালেদা জিয়ার উচিত জামায়াতের সঙ্গ ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরে রাজনীতি শুরু করা।’