নতুন বেতন কমিশন : ভাতা শতভাগেরও বেশি বাড়ানোর সুপারিশ
বেতনের তুলনায় বেশি হারে বাড়িভাড়া ভাতা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে জাতীয় বেতন ও চাকরি কমিশন। বিদ্যমান বেতন স্কেলে মূল বেতনের সর্বোচ্চ ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িভাড়া পাওয়া যায়। এবারের প্রস্তাবে তা সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত দেওয়ার কথা বলা হয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার ভেতরে। তবে সর্বনিম্ন হার নির্ধারণ করে দেওয়ায় কোনো কোনো গ্রেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এর চেয়েও বেশি হারে বাড়িভাড়া পাবেন। এ ছাড়া শিক্ষা ভাতা প্রতি সন্তানের ক্ষেত্রে (সর্বোচ্চ দুই সন্তান) ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার এবং চিকিৎসা ভাতাও দ্বিগুণ করে ১৫০০ টাকা করার সুপারিশ করেছে কমিশন। সব মিলিয়ে ১ নম্বর গ্রেডের কর্মকর্তারা মাস শেষে বেতন-ভাতা বাবদ এক লাখ ২৭ হাজার টাকা এবং সর্বনিম্ন ১৬ নম্বর গ্রেডের কর্মচারীরা ২০ হাজার ৮০০ টাকা পাবেন। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঝুঁকি ভাতা কমিয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে নামাতে, আর অবসরে যাওয়া চাকরিজীবীদের উৎসব ভাতা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করার সুপারিশ রয়েছে নতুন বেতন কাঠামোয়। বাড়িভাড়া মূল বেতনের ৫০-৭০%
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে জমা দেওয়া কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তাতে বর্তমানে বাড়িভাড়া বাবদ বিভিন্ন গ্রেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে টাকা পান, এবার তার দ্বিগুণেরও বেশি দেওয়ার সুপারিশ রয়েছে। সে অনুযায়ী, মূল বেতন আট হাজার ২০০ থেকে ১২ হাজার ৯৯৯ টাকা পর্যন্ত হলে (১৬-১১ গ্রেড পর্যন্ত) তাঁরা ঢাকায় মূল বেতনের ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িভাড়া ভাতা পাবেন। তবে কোনো ক্ষেত্রেই এই ভাতার পরিমাণ ছয় হাজার ৫০০ টাকার কম হবে না। এই পর্যায়ের কর্মচারীদের চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, রংপুর, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর মেট্রোপলিটন এবং কক্সবাজার ও ঢাকা জেলার সাভারের ক্ষেত্রে বাড়িভাড়া ভাতা হবে মূল বেতনের ৬৫ শতাংশ। তবে এ ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ভাতা ছয় হাজার টাকার কম হবে না। ১৬ থেকে ১১তম গ্রেডের কর্মচারীরা দেশের অন্যান্য জেলা শহরে কর্মরত থাকলে মূল বেতনের ৬০ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা বাড়িভাড়া পাবেন। আর অন্যান্য স্থানের ক্ষেত্রে এই ভাড়া সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার অথবা মূল বেতনের ৫৫ শতাংশ হবে। তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে বাড়িভাড়া পেতে হলে ‘সরকারি বাসস্থান বরাদ্দ করা যায়নি’ মর্মে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের প্রত্যয়ন জমা দিতে হবে।
মূল বেতন ১৩ হাজার থেকে শুরু করে ২৪ হাজার ৯৯৯ টাকা পর্যন্ত (৯ম ও ১০ম) গ্রেডের ক্ষেত্রে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় বাড়িভাড়া ভাতা হবে মূল বেতনের ৬৫ শতাংশ। তবে তা ১০ হাজার টাকার কম হবে না। এই শ্রেণির কর্মকর্তারা দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহর ও মেট্রোপলিটন এলাকা এবং কক্সবাজার ও সাভারে কর্মরত থাকলে বাড়িভাড়া বাবদ পাবেন মূল বেতনের ৫৫ শতাংশ। তবে এর পরিমাণ আট হাজার ৫০০ টাকার কম নয়। জেলা শহরের ক্ষেত্রে বাড়িভাড়া হবে মূল বেতনের ৫০ শতাংশ, যা সর্বনিম্ন আট হাজার টাকা হবে। আর অন্যান্য স্থানের ক্ষেত্রে ভাতা হবে মূল বেতনের ৪৫ শতাংশ। তবে তা সাত হাজার ২০০ টাকার কম নয়।
বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়াদের মধ্যে যাঁদের মূল বেতন ২৫ হাজার থেকে ৪৪ হাজার ৯৯৯ টাকা (৮ম-৬ষ্ঠ গ্রেড) ঢাকা মেট্রোপলিটনে তাঁরা বাড়িভাড়া পাবেন মূল বেতনের ৬০ শতাংশ, তবে তা কোনোমতেই ২০ হাজার টাকার কম হবে না। অন্যান্য বিভাগীয় শহর, সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকা, কক্সবাজার ও সাভারে কর্মরত থাকলে বাড়িভাড়া ভাতা হবে মূল বেতনের ৫০ শতাংশ, তবে তা হবে ন্যূনতম ১৬ হাজার টাকা। জেলা শহরে এ ভাতা হবে মূল বেতনের ৪৫ শতাংশ, সর্বনিম্ন ১৩ হাজার টাকা এবং অন্যান্য স্থানে বাড়িভাড়া ভাতা হবে মূল বেতনের ৪০ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ভাতা হবে ১১ হাজার ৫০০ টাকা।
আর যাদের মূল বেতন ৪৫ হাজার ও এর উর্ধ্বে (৫ম-১ম গ্রেড পর্যন্ত) ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় তাঁদের বাড়িভাড়া ভাতা হবে মূল বেতনের ৫০ শতাংশ। তবে এর পরিমাণ সর্বনিম্ন ২৮ হাজার ও সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকার বেশি হবে না। এই শ্রেণির কর্মকর্তারা দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহর ও মেট্রোপলিটন এলাকা এবং কক্সবাজার ও সাভারে কর্মরত থাকলে বাড়িভাড়া পাবেন মূল বেতনের ৪৫ শতাংশ। তবে এর পরিমাণ ২৩ হাজারের কম ও ৩৬ হাজার টাকার বেশি হবে না। জেলা শহরের ক্ষেত্রে বাড়িভাড়া ভাতা হবে মূল বেতনের ৪০ শতাংশ, যা সর্বনিম্ন ২১ হাজার ও সর্বোচ্চ ৩২ হাজার টাকা হবে। আর অন্যান্য স্থানের ক্ষেত্রে বাড়িভাড়া হবে মূল বেতনের ৩৫ শতাংশ। তবে তা ১৯ হাজার টাকার কম ও ২৮ হাজার টাকার বেশি হবে না।
শিক্ষায় পাঁচ গুণ, চিকিৎসা ও যাতায়াতে দ্বিগুণ বাড়ানোর সুপারিশ
বিদ্যমান বেতন কাঠামোয় প্রত্যেক গ্রেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এক সন্তানের জন্য ২০০ এবং দুই সন্তানের জন্য ৩০০ টাকা করে শিক্ষা ভাতা পান। কমিশনের সুপারিশে এবার তা পাঁচ থেকে সাত গুণ পর্যন্ত বাড়ানোর সুপারিশ করে এক সন্তানের জন্য শিক্ষা ভাতা এক হাজার টাকা ও দুই সন্তানের জন্য দুই হাজার টাকা করতে বলা হয়েছে। এখন সবার চিকিৎসা ভাতা মাসে ৭০০ টাকা। কমিশন এখন তা ১৫ শ টাকা নির্ধারণের সুপারিশ করেছে। প্রত্যেক কর্মচারী যাতায়াত ভাতা পান ১৫০ টাকা। কমিশন তা বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার প্রস্তাব করেছে। রয়েছে পাহাড়ি ও হাওর এলাকার চাকরিজীবীদের জন্য ‘দুর্গম ভাতা’র সুপারিশও।
স্থিতি ভাতা ৭,০০০-১০,০০০ টাকা
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নতুন চাকরিতে যোগদান করলে প্রথম মাসে তাঁদের খরচ বেশ বেড়ে যায়। কর্মস্থলে আবাসনের ব্যবস্থা করা, অফিসে নিয়মিত যাতায়াত ব্যয়- এগুলো মেটাতে হয় প্রথম মাসের বেতন পাওয়ার আগেই। ফলে তাঁদের ওপর আর্থিক চাপ পড়ে। এ অবস্থায় চাকরিতে যোগদানকালেই স্থিতি ভাতা নামে একটি ভাতা বরাদ্দের পরামর্শ দিয়েছে কমিশন। তাতে গ্রেড-১ থেকে ৮ম পর্যন্ত স্থিতি ভাতা ১০ হাজার এবং ৯ম থেকে ১৬তম গ্রেড পর্যন্ত তা সাত হাজার টাকা নির্ধারণের পক্ষে কমিশন।
আপ্যায়ন ও টিফিন ভাতা
সরকারের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম যুগ্ম সচিব পর্যায় থেকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব পর্যন্ত কর্মকর্তাদের আপ্যায়ন ভাতা দেড়গুণ বাড়ছে। এতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব তিন হাজার, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিব দুই হাজার ৪০০, সচিব দেড় হাজার, অতিরিক্ত সচিব এক হাজার ৪৫০ এবং যুগ্ম সচিব ও অন্যান্য প্রাধিকারভুক্ত কর্মকর্তাদের ৯০০ টাকা করে আপ্যায়ন ভাতা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। আর ৯ম থেকে ১৬তম গ্রেড পর্যন্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মাসে ৩০০ টাকা করে টিফিন ভাতা পাবেন।
পেনশনারদের উৎসব ভাতা দ্বিগুণ
অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একমাত্র আয়ের পথ পেনশন ভাতা। বর্তমান কাঠামোয় এ ভাতার পরিমাণ ৮০ শতাংশ। তা বাড়িয়ে ৯০ শতাংশ নির্ধারণের পক্ষে সুপারিশ করেছে কমিশন। তবে পেনশনারদের প্রতিটি উৎসব ভাতা দ্বিগুণ করার পক্ষে মত দিয়েছে তারা।
ঝুঁকি ভাতা কমিয়ে যৌক্তিকীকরণের পক্ষে মত
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিদ্যমান বেতন কাঠামোর বাইরেও বিভিন্ন হারে ঝুঁকি ভাতা নামে অতিরিক্ত অর্থ পেয়ে থাকেন। র্যাবের ক্ষেত্রে এটি ৭০ শতাংশ। পুলিশ, কারা পুলিশ, আনসার, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের জনবল এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্যান্য সদস্য ৪০ শতাংশ হারে ঝুঁকি ভাতা পান। এখন যেহেতু বেতন-ভাতা তাঁদের যথেষ্ট বাড়বে, তাই এসব ভাতা যৌক্তিক হারে কমানোর পক্ষে কমিশন।
প্রেষণ বাতিল, সাশ্রয় হবে ৬০০ কোটি
প্রেষণ বা ডেপুটেশনে নিয়োগ পাওয়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রেষণ ভাতা বাবদ বছরে সরকারের ব্যয় হয় প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। এবার প্রেষণ বাতিলের সুপারিশ থাকায় এই ভাতা বিলুপ্ত হবে।