ফিরে দেখা ২০১৪: আলোচিত ৮ হত্যাকাণ্ড
২০১৪ সালে দেশে কয়েকটি আলোচিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে র্যাবের হাতে নারায়ণগঞ্জে সাত খুন, রাজধানীর বিহারী পল্লীতে হামলা ও অগ্নিসংযোগে ১০ জন এবং সুন্দরবনে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্ধুকযুদ্ধে ১৩ জন নিহত হওয়ার ঘটনা বেশি আলোচিত হয়।
এ ছাড়াও রাজধানীতে আহলে সুন্নাতের নেতা নুরুল ইসলাম ফারুকী ও ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক হত্যা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত্যা, রাজধানীর মগবাজারে তিন খুন ও কেরানীগঞ্জে চার খুনের ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়।
নারায়ণগঞ্জে সাত খুন
২০১৪ সালের সবচেয়ে আলোচিত হত্যাকাণ্ড হল নারায়ণগঞ্জে সাত খুন। এই হত্যাকাণ্ডের পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে র্যাব-১০ জড়িত ছিল। এর মধ্যে র্যাব-১০ এর শীর্ষ তিন কর্মকর্তার নামও উঠে আসে। পরে তারা আদালতে বিষয়টি স্বীকারও করেছেন। র্যাব সদর দফতরের তদন্তেও বিষয়টি উঠে আসে।
গত বছরের ৩০ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বস্তাবন্দী সাতটি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর মধ্যে জেলা আইনজীবী সমিতির চন্দন সরকার ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামও রয়েছেন।
এই ঘটনার মূল হোতা বলে পরে প্রকাশ পায় নূর হোসেনের নাম। তিনি আওয়ামী লীগ নেতা ও নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠজন।
র্যাব এই ঘটনার পর বিষয়টি অস্বীকার করে এলেও গণমাধ্যমে বিষয়গুলো প্রকাশ পেতে থাকলে র্যাব-১০ এর তিন শীর্ষ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করে প্রতিরক্ষা বিভাগ।
এরা হলেন- তৎকালীন র্যাব-১০ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদ, মেজর আরিফ ও লে. কমান্ডার এম এম রানা।
এই তিন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করার পরই পুলিশ তিন সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে। প্রথমে তারা হত্যার সঙ্গে জড়িত নয় বলে দাবি করলেও পরে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়।
এ পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার ঘটনায় ২৪ জন আসামি গ্রেফতার হয়েছেন। মূল আসামি নূর হোসেন কলকাতায় গ্রেফতার হয়েছেন।
তবে এ ঘটনার সাত মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত পুলিশ এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে পারেনি।
একরাম হত্যা
বছরের আলোচিত হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক হত্যা। গত ২০ মে একরামুলকে কুপিয়ে এবং পুড়িয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এই ঘটনায় পুরো দেশেই আলোড়ন সৃষ্টি হয়। অভিযোগের তীর উঠে স্থানীয় সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে।
তবে এই ঘটনার পর নিহতের ভাই রেজাউল হক জসিম বাদী হয়ে মাহাতাব উদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী মিনারের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৩০-৩৫ জনকে আসামি করে ফেনী মডেল থানায় মামলা করেন।
পুলিশ ৫৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়, যার মধ্যে ৩১ জন গ্রেফতার রয়েছেন। পলাতক আছেন ২৫ জন। গ্রেফতারদের মধ্যে ফেনীতে রয়েছেন ৩০ জন এবং ঢাকায় চিকিৎসাধীন আছেন বিএনপি নেতা মাহাতাব উদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী মিনার।
বিহারী পল্লীর হত্যাকাণ্ড
গত ১৪ জুন মিরপুর কালশীর কুর্মিটোলা বিহারী পল্লীতে হামলা এবং অগ্নিসংযোগে ১০ জন নিহত হয়। আতশবাজি নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে বিহারীদের বিরোধ সৃষ্টি হয়। এর জের ধরে বিহারী পল্লীতে হামলা এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে একই পরিবারের ৯ জন অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়। এই ঘটনার কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ।
অভিযোগ আছে, স্থানীয় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লার নির্দেশে পুলিশের সহায়তায় স্থানীয় যুবলীগ কর্মীরা এই হামলা চালায়। তবে ইলিয়াস মোল্লা এবং পুলিশ এই ঘটনা বরাবরই অস্বীকার করে আসছে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য এবং ঘটনার ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ঘটনার দিন পুলিশ মারমুখী অবস্থানে ছিল। এমনকি বিহারী পল্লী ভাঙচুরের সময় দুর্বৃত্তদের সঙ্গে পুলিশও ছিল।
ফারুকী হত্যাকাণ্ড
গত ২৭ আগস্ট রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারে চ্যানেল আইয়ের উপস্থাপক ও বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের প্রেসিডিয়াম সদস্য নুরুল ইসলাম ফারুকীকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
এই ঘটনাটি ধর্মীয় মতাদর্শগত পার্থক্যের কারণে ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা ঘটিয়েছে বলে দাবি করে আসছে পুলিশ। ফারুকীর রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, মতাদর্শ ও স্বার্থগত কারণে জামায়াতপন্থী উপস্থাপকরা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তবে চার মাসেও এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি গোয়েন্দারা।
এই ঘটনার দিন রাতেই ফারুকীর ছোট ছেলে ফয়সাল ফারুকী শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা করেন। এতে অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করা হয়। মামলার এজাহারে ডাকাতি ও হত্যার কথা উল্লেখ করা হয়। পরে এজাহারে উল্লেখিত ডাকাতির বিষয়ে ফয়সাল নিজেই প্রশ্ন তুলেন। মামলার এজাহারে ডাকাতির বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে তা তিনি জানতেন না বলে দাবি করেন।
এ দিকে গত ৪ সেপ্টেম্বর ফারুকী হত্যার ঘটনায় ছয় টিভি উপস্থাপকের বিরুদ্ধে দলের পক্ষ থেকে আদালতে একটি মামলা করা হয়। মামলাটি থানায় করা আগের মামলার সঙ্গে যুক্ত করে একসঙ্গে তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত।
মগবাজারে তিন খুন
গত ২৮ আগস্ট মগবাজারের নয়াটোলা এলাকার সোনালীবাগের একটি বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন বৃষ্টি আক্তার ওরফে রানু, তার বাড়ির ভাড়াটে মুন্না ও বিল্লাল হোসেন।
পুলিশ জানায়, জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটায় কালা বাবু।
ঘটনার পরের দিন নিহত বৃষ্টি আক্তার রানুর ভাই শামীম ওরফে কালা চাঁদ রমনা থানায় শাহ আলম ওরফে কালা বাবুকে প্রধান আসামি করে ১৫ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, কালা বাবু ও তার সহযোগী সন্ত্রাসীরা সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে কালা চাঁন ওরফে শামীমের কাছে চাঁদা চেয়ে আসছিল। চাঁদা না দেওয়ায় তারা কালা চাঁনের বোনকে ও তার বাড়ির দুই ভাড়াটিয়াকে গুলি করে হত্যা করে।
এ দিকে, ১৫ সেপ্টেম্বর ভোর ৪টায় রাজধানীর মগবাজার ওয়্যারলেস গেট এলাকায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধ’-এ প্রধান আসামি শাহ আলম ওরফে কালা বাবু নিহত হন। এরপর ১৯ সেপ্টেম্বর রাত ৯টার দিকে এ কিলিং মিশনে অংশগ্রহণকারী আল আমিন, ২০ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১২টার দিকে মো. সাইফুল্লাহ সিয়াম, মো. রমজান আলী, মো. রুবেল মিয়া ওরফে সানি, মো. মারুফ হোসেন, মো. শাফিন লস্করকে গ্রেফতার করে র্যাব।
কেরানীগঞ্জে চার খুন
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে চার খুন আলোচিত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে অন্যতম। চুরি ও ডাকাতির টাকা, মালামাল ভাগাভাগি এবং পরকীয়ার সম্পর্কের জের ধরে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশ দাবি করেছে।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর সকালে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের কদমপুর গ্রামে একটি বাড়ির দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাটে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় দুই শিশুসহ একই পরিবারের চারজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহতরা হলেন— সাজু আহমেদ, তার স্ত্রী রাজিয়া বেগম রঞ্জি, তাদের ছেলে ইমরান ও মেয়ে সানজিদা।
এ ঘটনায় সাজুর ভাই বশির উদ্দিন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। পুলিশের দাবি, নিহত সাজু ডাকাত দলের সদস্য ছিল। মামলার পর অভিযান চালিয়ে এ হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকায় নাছির, মো. সুমন, জনি, আ. মজিদ, মো. রফিক, সাহিদা বেগম, মুক্তা বেগম ও রানী বেগমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সাজু এদের সহযোগী হিসেবে ডাকাতি করত বলে পুলিশ জানায়।
সুন্দরবনে পুলিশের ক্রসফায়ার
সুন্দরবনে পুলিশের সঙ্গে দুই দফায় বন্দুকযুদ্ধে বনদস্যু কাশেম বাহিনীর ১৩ সদস্য নিহত হয়। গত ৫ অক্টোবর ভোরে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটির জিরবুনিয়া গ্রামে দুইজন এবং দুপুর ২টার দিকে কালাবগি সংলগ্ন সুন্দরবনের গহীনে হড্ডায় ১১ জন নিহত হয়।
এ ঘটনায় পাইকগাছা থানায় নিহতদের বিরুদ্ধে তিনটি ও পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে দু’টি মামলা করা হয়। এর আগে খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বন্দুকযুদ্ধে একসঙ্গে এত সংখ্যক নিহতের ঘটনা ঘটেনি।
পুলিশের দাবি, বনদস্যু কাশেম বাহিনী চাঁদার দাবিতে দেলুটির জিরবুনিয়া গ্রামের কলেজশিক্ষক প্রশান্ত কুমার ঢালীকে অপহরণ করে। এ সময় জনতা ও পুলিশ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। গণপিটুনি ও পুলিশের গুলিতে করিমুল ও আজিবুর নামে দুই বনদস্যু নিহত হয়। ঘটনাস্থল থেকে জনতার সহায়তায় ১১ ডাকাতকে আটক করা হয়। পরে তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সুন্দরবনের গহীনে গাংরকির চরে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চালানো হয়। অভিযান চলাকালে দুপুর ২টার দিকে কাশেম বাহিনীর অন্য সদস্যরা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। পুলিশও পাল্টা গুলি করে। এরই এক পর্যায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আটক ১১ বনদস্যু মারা যায়।
তবে স্থানীয়দের দাবি- এরা সবাই বনদস্যু নয়। পরিবারগুলোও বলছে, পুলিশ ঠাণ্ডা মাথায় তাদের হত্যা করেছে।
রাজশাহীতে শিক্ষক হত্যা
গত ১৫ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শফিউল ইসলাম নিলনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৬ নভেম্বর নগরীর মতিহার থানায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রফেসর এন্তাজুল হক বাদী হয়ে মামলা করেন। হত্যাকাণ্ডের ক্লু উদঘাটনে গোয়েন্দারা মাস্টার্সের ফলপ্রার্থী এক ছাত্রীকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। হত্যাকাণ্ডের পরপরই ওই শিক্ষকের বাসায় তল্লাশি চালিয়ে তাকে আটক করা হয়।
পরবর্তী সময়ে র্যাবের হাতে গ্রেফতার কাটাখালী পৌর যুবদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আরিফুল ইসলাম মানিক, যুবদল কর্মী সবুজ, পিন্টু, আল-মামুন ও সিরাজুল ইসলাম কালুকে রাজশাহী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৩ এ হাজির করে দুই দিনের রিমান্ডে নেয় র্যাব। আদালতের নির্দেশে গ্রেফতার জিন্নাত, আরিফ ও সাগরকে দুই দফায় তিন দিনের এবং ইব্রাহিম খলিল ওরফে টোকাই বাবুকে তিন দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ।
র্যাব ও পুলিশের দাবি, কাটাখালী যুবদলের এক নেতার স্ত্রীর সঙ্গে ওই শিক্ষকের অসৌজন্যমূলক আচরণের সূত্র ধরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে।