পরীক্ষায় তারেক
সরকার পতনের নতুন আন্দোলনে নেতৃত্ব নিয়ে পরীক্ষার মুখোমুখি হচ্ছেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সামনের আন্দোলনে দলের হাইকমান্ড থেকে শুরু করে সিনিয়র নেতারা যদি সরকারের রোষানলে পড়ে গ্রেফতার হন, তাহলে লন্ডনে থেকেই সেই আন্দোলনকে টেনে নেওয়ার দায়িত্বপালন করবেন তারেক।
বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচ্য হচ্ছে। বিএনপি ও জোট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, বিগত আন্দোলনে তৃণমূল ব্যাপকভাবে সক্রিয় থাকলেও কেন্দ্রীয় নেতাদের রহস্যজনক নিষ্ক্রিয়তার কারণে সফল হতে পারেনি বিএনপি। তাই এবারের আন্দোলন নিয়ে আগের চেয়ে সচেতন ও হিসাব-নিকাশ করে পদক্ষেপ নিচ্ছেন দলের হাইকমান্ড। কিন্তু আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণার পর হাইকমান্ড থেকে শুরু করে দলের উল্লেখযোগ্য সিনিয়র নেতাদের গ্রেফতারের সম্ভাবনার কথাও মাথায় রাখছেন তিনি। সে জন্য বিকল্প নেতৃত্বের কথা ভাবছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সেক্ষেত্রে লন্ডনে নির্বাসিত চিকিৎসাধীন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের হাতেই পড়ছে এ গুরু দায়িত্ব।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘তারেক রহমান দলের দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন। সময় বলে দেবে, তিনি কিভাবে নেতৃত্ব দেবেন। তিনি চিকিৎসার জন্য লন্ডনে আছেন। তবে এই প্রযুক্তির যুগে ওখানে বসেও তিনি জনগণকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পারবেন।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি বড় রাজনৈতিক দল। এ দলে বিভিন্ন পর্যায়ের যোগ্য নেতৃত্ব আছে। সিনিয়র নেতারা গ্রেফতার হলেও আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো নেতার অভাব বিএনপিতে হবে না। এর আগেও সরকার বিএনপির অনেক নেতাকে গ্রেফতার করেছে। তখনও নেতৃত্বের কোনো সঙ্কট বিএনপিতে হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না।’
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে সরকার পতনের হুমকি ও ঘোষণা দিয়ে আসছে দলটি। অবশেষে এ ঘোষণা বাস্তবায়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছে তারা।
সূত্র জানায়, ডিসেম্বর মাসের শেষ দিক থেকেই সরকার পতন আন্দোলনে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল বিএনপি ও জোটনেত্রী খালেদা জিয়ার। এলক্ষ্যে তিনি ইতোমধ্যে নিজদল, জোট ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন তথা যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, শ্রমিক দলসহ অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ সব সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে খালেদা জিয়া তাদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘তোমরা জেলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত কি না? যদি জেলে যেতে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাক তবে আন্দোলন হবে। নইলে পদ ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে থাক।’
দলীয় প্রধানের এমন জিজ্ঞাসার জবাবে নেতারা তার সামনে আন্দোলনের মাঠে থাকার জন্য শপথ নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
তবে ডিসেম্বর থেকে আন্দোলন প্রশ্নে খালেদা জিয়া কিছুটা সময় নিচ্ছেন। এর পেছনে ২০ দলীয় জোটের শরিক জামায়াতের একটি শর্ত জড়িত বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সূত্র মতে, সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোট নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার গুলশানের বাসায় জামায়াতের দুই সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল সাক্ষাৎ করে। তাদের মধ্যে ছিলেন জামায়াত কর্মপরিষদ সদস্য মজিবুর রহমান মঞ্জু ও সাবেক সংসদ সদস্য ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তারা বেশ কিছু সময় জোট নেত্রীর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। বৈঠকে আন্দোলন প্রশ্নে খালেদা জিয়া জামায়াতের কাছে কাঙ্ক্ষিত ‘পারফরমেন্স’ দাবি করলে জামায়াতের পক্ষ থেকেও তাকে একটি শর্ত দেওয়া হয়। তা হচ্ছে- আন্দোলনের মাঠে খালেদা জিয়াকে নেতৃত্ব দিতে হবে। অন্তত শুরুর দিন তাকে (খালেদা জিয়া) রাজপথে নেতৃত্ব দিতে হবে। হোক তা র্যাব-পুলিশের বাধায় স্বল্প সময়। সেটা নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অথবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অথবা অন্য কোথাও। মোট কথা শুরুটা খালেদা জিয়াকেই করতে হবে। বাকি সময় আন্দোলন টেনে নেওয়ার দায়িত্ব জামায়াত পালন করবে বলেও তাকে আশ্বস্ত করা হয়।
জামায়াতের এ শর্তে খালেদা জিয়া তাদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘তিনি অবশ্যই মাঠে নামবেন। উপযুক্ত সময় হলেই তিনি রাজপথের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবেন।’
বিএনপি ও ২০ দলীয় জোট নেত্রী খালেদা জিয়া বারবার বলে আসছেন, শিগগিরই সরকার পতনের ডাক দেওয়া হবে। এ ডাকে দলের নেতাকর্মী, বিভিন্ন পেশাজীবী, ছাত্র, শ্রমিক, জনতা এমনকি মা-বোনদেরও শামিল হতে তিনি আহ্বান জানাচ্ছেন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে নব্বই দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সাবেক ছাত্র নেতাদের জাতীয় কনভেনশনেও তিনি সরকার পতনের আন্দোলনের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
সূত্র জানায়, সরকার পতন আন্দোলনের ডাক দেওয়ার পর পরই গ্রেফতার হতে পারেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের সিনিয়র নেতারা। গ্রেফতারের শঙ্কা ও সম্ভাবনা নিয়ে দায়িত্বশীলদের সঙ্গে কথা বলছেন বিএনপি ও জোটের হাইকমান্ড।
এমনকি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের দুই কোটি টাকার দুর্নীতি মামলায় সরকার যেকোনো সময় স্বয়ং খালেদা জিয়াকে আটক করতে পারে বলেও দলীয় ফোরামে আলোচনা চলছে। খালেদা জিয়াকে যদি সরকার গ্রেফতার করে পরবর্তী সাংগঠনিক নেতা হিসেবে বিএনপির আন্দোলন টেনে নেওয়ার দায়িত্ব দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের। কিন্তু বর্তমানে ৬৬টি মামলায় নিয়মিত মির্জা ফখরুলকে মাসের প্রায় প্রতিদিনই আদালতে হাজিরা দিতে হয়। তার এ সব মামলার মধ্যে ইতোমধ্যেই ২৪টি মামলার চার্জও গঠন করা হয়েছে। যেকোনো সময় এ সব মামলার শুনানি শুরু হবে। তাই কার্যত মির্জা ফখরুলও কারাগারের পথে অনেকটা এগিয়ে রয়েছেন বলে দলীয় ও জোট সূত্রে আলোচনা হচ্ছে। এ ছাড়া স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ অন্য সিনিয়র নেতাদের মধ্যে প্রায় সবাই একাধিক মামলার অভিযুক্ত হিসেবে আদালতে যাওয়া আসা করছেন।
আন্দোলন শুরুর পর বিএনপি ও জোট নেতাদের গ্রেফতারের পর বিকল্প নেতৃত্ব সম্পর্কে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) সভাপতি শফিউল আলম প্রধান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমরা গোপন কোনো রাজনীতি করি না। আমাদের রাজনীতি সব প্রকাশ্যে। রাজপথে থেকেই গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আমরা নেতৃত্ব প্রত্যাশা করি। আশাকরি সরকার আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সুযোগ দেবে। মনে রাখতে হবে, আন্দোলন বলে-কয়ে হয় না। তাই কে গ্রেফতার হবে, কে নেতৃত্ব দেবে তা আগে থেকে বলা যায় না।’
তিনি বলেন, ‘তারেক রহমান দেশের জনগণের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় মুখ। তিনি যদি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তাহলে আমি ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত খুশী হব।’
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘খুব শিগগিরই সরকার পতন কর্মসূচি ঘোষণা করবেন জোট নেত্রী খালেদা জিয়া। তার দেওয়া কর্মসূচি অনুযায়ী বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের লাখ লাখ নেতাকর্মীর সঙ্গে দেশের সাধারণ জনগণ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে।’
তিনি বলেন, ‘কর্মসূচি ঘোষণার জোট নেত্রী খালেদা জিয়া ও অন্য সিনিয়র নেতাদের সরকার গ্রেফতার করতে পারে। গ্রেফতার করতে পারে জোটের সিনিয়র নেতাদের। সেক্ষেত্রে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান এ আন্দোলনকে সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি।’