নির্ঘুম রাত কাটছে বিএনপি নেতাকর্মীদের
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দলীয়প্রধান খালেদা জিয়ার হাজিরার দিন থেকে নতুন করে গ্রেফতার আতঙ্ক মাথায় নিয়ে সময় পার করছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।
গ্রেফতার, হয়রানি মাথায় নিয়ে নির্ঘুম রাত পার করলেও ডাক পাওয়া মাত্রই আন্দোলনের মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ার শপথ নিচ্ছেন নেতাকর্মীরা।
গত ২৪ ডিসেম্বর পুরান ঢাকার বকশীবাজারে বিডিআর বিদ্রোহের বিচারে গঠিত অস্থায়ী আদালতে হাজিরা নির্ধারিত ছিল খালেদা জিয়ার। এ উপলক্ষে সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার নেতাকর্মী ও উৎসুক সাধারণ মানুষ হাজির হয়েছিল বকশীবাজার এলাকায়। সেখানে এ সব নেতাকর্মী রাজপথে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিল। এক পর্যায়ে বুয়েট প্রান্ত থেকে ছাত্রলীগের কিছু অস্ত্রধারী ডা. ফজলে রাব্বী হল মোড়ে অবস্থান নেওয়া বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায়। পুলিশও কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছোড়ে। বিক্ষিপ্ত কিছু সংঘর্ষ ও ইট ছোড়াছুড়ির ঘটনা ঘটে। ছয় শতাধিক বিএনপি নেতাকর্মী গুরুতর আহত হয়। আটক হয় অর্ধশতাধিক। পরদিন পুলিশ বাদী হয়ে চকবাজার ও শাহবাগ থানায় পৃথক দুটি মামলা করে। এ সব মামলায় দুই শতাধিক নেতাকর্মীর নাম ও বিপুলসংখ্যক অজ্ঞাতপরিচয় নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়।
বকশীবাজারের মামলায় আসামি করা হয়েছে ঢাকা মহানগর বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু, মহানগর সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সুলতান সালাহউদ্দিন টুকুসহ অন্যদের। এ ছাড়া অজ্ঞাতসহ প্রায় ২০০ নেতাকর্মীকে এ মামলায় জড়ানো হয়েছে। ইতোমধ্যে অলিখিতভাবে ঢাকাসহ সারা দেশে ধরপাকড় শুরু হয়েছে। দুই দিন ধরে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ অভিযানও চলছে।
বকশীবাজারের ঘটনার একদিন পর বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীর একটি বাড়ি থেকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার করে। ইতোমধ্যে তাকে পুলিশ আদালতের মাধ্যমে তিন দিনের রিমান্ডেও নিয়েছে। গত শনিবার রাতে রাজধানীর লালমাটিয়ার বাসা থেকে ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করে বিএনপির যুব বিষয়ক সম্পাদক ও যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে। রবিবার তাকেও পুলিশ তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে।
এদিকে গত শুক্রবার রাতে পুলিশ মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের সার্কিট হাউসের বাসায় তল্লাশি চালায়। একই রাতে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বাসায়ও তল্লাশি চালানো হয়। শনিবার রাত আড়াইটায় স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিউল বারী বাবুর শাহজাহানপুরের বাসায় ব্যাপক তল্লাশি চালায়। তবে তাকে না পাওয়ায় তিনি এখনো গ্রেফতারের বাইরে রয়েছেন।
শুক্রবার রাতে পুলিশ রাজধানীর উত্তরায় যুবদল যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাহাঙ্গীরের বাড়িতেও তল্লাশি চালিয়েছে।
রাজধানীর আদাবর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি জামাল উদ্দিনের বাসায় তল্লাশি চালায়। এ সময় পুলিশ জামাল ও তার ছেলে আশকারীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।
এদিকে গাজীপুরে ২০ দলীয় জোটের সমাবেশ করতে না দেওয়া, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেওয়া, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আব্দুস সালাম পিন্টু, লুৎফুজ্জামান বাবর, নাসিরউদ্দিন পিন্টুসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী সোমবার সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়েছে বিএনপি।
বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে শনিবার সন্ধ্যায় ২০ দলীয় জোটের মহাসচিব পর্যায়ের বৈঠক শেষে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হরতালের এ ঘোষণা দেন।
দেশব্যাপী হরতালের এ ঘোষণার পর নতুন করে আবারও গ্রেফতারের মুখে পড়েছে বিএনপি নেতাকর্মীরা। প্রতিদিন-প্রতিরাতেই তারা পুলিশি তল্লাশির মুখে পড়ছেন। অনেকে হচ্ছেন গ্রেফতার। রাত কাটাচ্ছেন নির্ঘুম। নিজ বাসা-বাড়ি ও স্ত্রী-পুত্র-পরিজন ছেড়ে ফেরারি জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন অনেক নেতাকর্মী।
বিএনপি সূত্রে জানা যায়, বিএনপি ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের মাঠপর্যায় থেকে শুরু করে মধ্যম সারির নেতারা ইতোমধ্যেই সতর্কভাবে চলাফেরা শুরু করেছেন। অনেকেই রাতে বাসায় থাকা বন্ধ করে দিয়েছেন।
বিএনপি নেতাদের দাবি, গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমাতেই সরকার নতুন করে মামলা ও গ্রেফতার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এভাবে হয়ত সাময়িকভাবে আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করা যাবে। কিন্তু দেশের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন এই সরকার দীর্ঘমেয়াদে নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নেতাকর্মীদের আটকের ব্যাপারে বলেন, ‘বর্তমান নিষ্ঠুর শাসকগোষ্ঠী বিরোধী দল, মত ও সমালোচনা সহ্য করতে পারছে না। এ জন্য সরকার নানাবিধ সহিংসতার পাশাপাশি গ্রেফতার অভিযান চালিয়ে বিরোধী দলের অস্তিত্ব শূন্য করে দেওয়ার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। এ সব নিষ্ঠুর অপকর্মের মাধ্যমে বিএনপিকে ধ্বংস করার চক্রান্ত কোনো দিনই সফল হবে না।’
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে তিন হাজার মামলায় কমপক্ষে সাড়ে সাত লাখ নেতাকর্মীকে জড়ানো হয়েছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় থেকে শুরু করে দল ও অঙ্গসংগঠনের সব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধেই অন্তত ডজনখানেক করে মামলা রয়েছে। কারো কারো বিরুদ্ধে আছে শতাধিক মামলা। সরকারবিরোধী আন্দোলনে এ সব মামলা নিয়েও বিএনপিতে দুশ্চিন্তা রয়েছে। তারপরও এ সব বাধা উপেক্ষা করে নতুন নির্বাচনের দাবিতে নতুন বছরের শুরু থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে দলটির।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, কয়েকদিন ধরে দলের মাঠপর্যায় থেকে শুরু করে মধ্যসারির নেতারা সতর্কভাবে চলাফেরা করছেন। অনেকেই মোবাইল ফোন বন্ধ রাখছেন। রাতে বাসায়ও থাকছেন না। মাঠের নেতাদের সাবধান-সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা করার পরামর্শ দিয়েছেন দলের হাইকমান্ডও।