জাতীয় ক্রিকেট : সাফল্য-দুর্ভাগ্য এবং স্মরণ
ঘটনা আছে, সঙ্গে অঘটনও রয়েছে। পুরনো গল্পের ধারাবাহিকতা আছে, নতুন গল্পের অবতারণাও হয়েছে; রয়েছে বিজয় উল্লাসের বিপরীতে পরাজয়ের গ্লানি; হঠাৎ বিশ্বতারকা বনে যাওয়া ক্রিকেটারদের গল্প যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ক্রিকেট মঞ্চ থেকে বিদায় নেওয়া তারকাদের কথা; প্রিয়জনকে হারানোর বেদনার অন্যপাশে রয়েছে প্রিয় মানুষটির খেয়ালিপনায় মাথা নত হওয়ার লজ্জা; তর্ক-বিতর্ক রয়েছে, দুর্নীতির গল্পও রয়েছে; শান্তি কামনার সঙ্গে আছে কিংবদন্তিদের কথাও-সব মিলিয়ে বিশ্বক্রিকেটে ২০১৪ সালটা ঘটনাবহুল বছর হিসেবেই ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেবে।ক্রিকেটারদের ভবিষ্যত আলোচনায় অনেক কারণেই ঘুরে ফিরে আসবে এই বছরটির কথা।
টোয়েন্টি২০ বিশ্বকাপের সফল আয়োজক : টোয়েন্টি২০ বিশ্বকাপে সুন্দর ব্যবস্থাপনা, আতিথিয়েতা, হসপিটালিটি, সবমিলিয়ে চমৎকার আয়োজন করে শতভাগ সফল হয়েছে বাংলাদেশ। ২০১১ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ বিশ্বকাপের আয়োজক ছিল। সেখানেও সাফল্যের মালা পড়েছিল বাংলাদেশ। তবে এবার নিরাপত্তা নিয়ে সন্দেহ সংশয় থাকার পরও সফলতার সঙ্গেই আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। শুরুতে ভেন্যুগুলোর সংস্কার গতিতে আইসিসি অসন্তুষ্ট প্রকাশ করেছিল। ১৬ মার্চ বাংলাদেশ-আফগানিস্তানের মধ্যকার ম্যাচ দিয়ে পর্দা উঠে বিশ্বকাপের। আর ফাইনালে ভারত-শ্রীলঙ্কার ম্যাচ দিয়ে বিদায় নিয়েছে এবারের আসর। একটি চরম বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিয়ে বিশ্বকাপের আয়োজন করা ছিল সত্যিকার অর্থেই চ্যালেঞ্জের বিষয়। স্বাগতিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্জন দু’টি। একটি হল আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এরকম আয়োজনে সক্ষমতার প্রমাণ দেওয়া; অন্যটি, বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হওয়া। পাশাপাশি অনেক গৌরবময় ঘটনার সাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশ। এতে বেড়েছে প্রত্যাশা, সঙ্গে আত্মবিশ্বাস।
টোয়েন্টি২০ বিশ্বকাপের স্বাগতিক হিসেবে এই খাতে ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পায় বিসিবি। গত বছর ৭ নভেম্বর থেকে অনলাইনে অগ্রীম টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছিল। অংশগ্রহণকারী দলগুলোর অনুশীলন ভেন্যুগুলো ছিল বিকেএসপির ২, ৩ ও ৪ নম্বর মাঠ, মিরপুর একাডেমি ও ইনডোর, ফতুল্লা আউটার স্টেডিয়াম, সিলেট ক্যাডেট কলেজ মাঠ ও জেলা স্টেডিয়াম, চট্টগ্রামের এমএ আজিজ স্টেডিয়াম, চট্টগ্রাম মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স। পুরুষদের মূল খেলাগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছে মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম, চট্টগ্রাম জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়ামে। অন্য দিকে মেয়েদের খেলাগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছে সিলেট বিভাগীয় স্টেডিয়ামে। অনেক গল্প রচিত হয়েছে এবারের টোয়েন্টি২০ বিশ্বকাপকে ঘিরে। লাল-নীল আলোর বন্যায় ভেসে যাওয়া ঢাকা শহরের নাগরিকেরা কম কষ্ট করেননি। বিশ্বকাপের জন্য পুরো শহরে ছিল জ্যাম। সবাই বিশ্বকাপ যাতে সফল হয়, সেই চিন্তা করে এই ত্যাগ স্বীকার করেছেন। দর্শকের বিপুল উপস্থিতি বিশ্ব ক্রিকেটকে বিস্মিত করেছে।
এশিয়ান গেমস : ইনচন এশিয়ান গেমসে ভাগ্যের কাছে হেরে স্বর্ণপদক হাতছাড়া হয়েছে দেশের পুরুষ ক্রিকেটারদের। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে টস ভাগ্যে হেরে ব্রোঞ্চ পদকের জন্য লড়তে হয়েছে বাংলাদেশকে। ৩ অক্টোবর হংকংকে ২৭ রানে হারিয়ে ব্রোঞ্জপদক জিতেও আনন্দ ছিল না গত আসরে স্বর্ণ জয়ীদের। যদিও এ জয়ে ব্রোঞ্জের পাশাপাশি টোয়েন্টি২০ বিশ্বকাপে হংকংয়ের কাছে হারের প্রতিশোধটা নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের। অন্যদিকে, গত এশিয়ান গেমসের মতো এবারও রৌপ্যপদক নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে প্রমীলা ক্রিকেটারদের। আগের আসরের ন্যায় এবারও পাকিস্তানের কাছে হেরে স্বর্ণপদক হাতছাড়া হয়েছিল বাংলাদেশের প্রমীলাদের। অথচ, মেয়েদের ফাইনাল জয়ের বিপুল সম্ভাবনা ছিল।
সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক : চলতি বছর টেস্ট এবং ওয়ানডে ২ ফরম্যাটের ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেটের মালিক সাকিব আল হাসান। ওয়ানডে ক্রিকেটে তার অবস্থান ১৩ নম্বর; অন্যদিকে টেস্ট ক্রিকেটে ১৫ নম্বর। ওয়ানডে ক্রিকেটে সাকিব ১২ ম্যাচে নিয়েছেন ২১ উইকেট। এছাড়া, মাশরাফি ১৩ ম্যাচে নিয়েছেন ১৮ উইকেট, আল-আমিন ১১ ম্যাচে ১৭ উইকেট, আরাফাত সানি ৮ ম্যাচে ১৬ উইকেট, রুবেল হোসেন ১০ ম্যাচে ১৩ উইকেট। ২০১৪ সালে ওয়ানডে ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি উইকেট নিয়েছেন শ্রীলঙ্কান স্পিনার অজন্তা মেন্ডিস। তিনি ১৭ ম্যাচে ৩৮ উইকেট শিকার করেছেন। ভারতীয় বোলার মোহাম্মদ সামি দ্বিতীয় অবস্থানে; তিনি ১৬ ম্যাচে ৩৮ উইকেট, তৃতীয় শ্রীলঙ্কান বোলার মালিঙ্গা ১৭ ম্যাচে ২৯ উইকেট দখল নিয়েছেন।
টেস্টেও বাংলাদেশী বোলারদের মধ্যে সবার ওপরে সাকিব। ৫ ম্যাচে ২৭ উইকেট নিয়েছেন তিনি। এছাড়া তাইজুল ইসলাম ৫ ম্যাচে ২৫ এবং জুবায়ের হোসেন লিখন ৩ ম্যাচে ১১ উইকেট নিয়েছেন। সবার ওপরে অবস্থান করছেন শ্রীলঙ্কান স্পিনার রঙ্গনা হেরাথ। তিনি ১০ ম্যাচে নিয়েছেন ৬০ উইকেট; দ্বিতীয় অবস্থানে জনসন ৮ ম্যাচে নিয়েছেন ৪২ উইকেট এবং তৃতীয় অবস্থানে অ্যান্ডারসন ৮ ম্যাচে নিয়েছেন ৪০ উইকেট।
সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক : চলতি বছর টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রহ করেছেন মুমিনুল হক। তিনি ৭ ম্যাচে ১৪ ইনিংস খেলে ৬১৪ রান সংগ্রহ করেছেন। সর্বোচ্চ রান করেছেন ১৩১*।
পরের অবস্থানে তামিম ইকবাল; সমান সংখ্যাক ম্যাচে তার সংগ্রহ ৫২২ রান। মুশফিকের সংগ্রহ ১৩ ইনিংসে ৪৩৩ রান, ১০ ইনিংসে ৪২৪ রান এবং ৬ ইনিংসে ইমরুলের সংগ্রহ ৩১৯ রান। এই বছর টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ সংগ্রাহক শ্রীলঙ্কার কুমারা সাঙ্গাকারা ২০ ইনিংসে করেছেন ১৪৮৬ রান।
এদিকে, চলতি বছর ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক মুশফিক। ১৮ ম্যাচে ৭০৪ রান মুশফিকের। ১ সেঞ্চুরির পাশাপাশি ৬টি হাফসেঞ্চুরি এসেছে তার উইলো থেকে। ৬৩১ রান নিয়ে দ্বিতীয়স্থানে রয়েছেন তরুণ ক্রিকেটার এনামুল হক বিজয়। বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম হলেও, রান সংগ্রাহক বিশ্বসেরার তালিকায় ১৫ নাম্বারে আছেন মুশফিক। আর এনামুল হক বিজয়ের স্থান ১৯ নাম্বারে। এছাড়া টেস্টের মত ওয়ানডে ক্রিকেটেও ১২৫৬ রান নিয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটে সবার উপরে রয়েছেন কুমারা সাঙ্গাকারা। ২৮ ম্যাচ খেলে এ রান করেছেন তিনি। ৩২ ম্যাচে ১২২৬ রান নিয়ে দ্বিতীয় ম্যাথুস। ২১ ম্যাচে ১০৫৪ রান নিয়ে তালিকায় তৃতীয়স্থানে আছেন ভারতের বিরাট কোহলি।
সাকিবের কৃর্তি : নিষাধাজ্ঞার খড়গ কাটিয়ে মাঠে নেমেই সাকিব ফিরেছেন নিজের স্টাইলে। জিম্বাবুয়ের সঙ্গে প্রত্যাবর্তনের সিরিজে দূর্দান্ত খেলেছেন সাকিব। খুলনা টেস্টেই নিজের চমক, ঝলক, রেকর্ড, কীর্তি সবই করে দেখিয়েছেন তিনি। ম্যাচে একটি সেঞ্চুরিতে ১৩৭ রান ও ১০ উইকেট শিকার করে রেকর্ড বইয়ে ইংল্যান্ডের স্যার ইয়ান বোথাম ও পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক ইমরান খানের পাশে বসেছেন ২৭ বছর বয়সী সাকিব। প্রায় ৩১ বছর পর বিশ্বের তৃতীয় খেলোয়াড় হিসেবে এমন কীর্তি গড়েছে বাংলাদেশের সাবেক এই অধিনায়ক। ফলে ২ মাসের ব্যবধানে আবারও টেস্ট র্যাংকিংয়ের শীর্ষস্থান ফিরে পেয়েছেন সাকিব। এর আগে ২০১১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষেও একই টেস্টে সেঞ্চুরি ও ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়েছিলেন তিনি। সাকিবের আগে একাধিকবার এই রেকর্ড গড়েছেন চারজন। গ্যারি সোবার্স, মোস্তাক মোহাম্মদ, ইয়ান বোথাম ও জ্যাক ক্যালিস। বিশ্বসেরাদের এই ক্লাবের নতুন সদস্য হয়েছেন সাকিব।
সাকিবের এই অর্জনের পর বিশ্বের নামকরা সংবাদ মাধ্যমগুলোতেও ঠাঁই করে নিয়েছেন তিনি। এছাড়া জিম্বাবুয়ের ব্যাটসম্যান ব্রেন্ডন টেলরকে ফিরিয়ে শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ৭৬তম উইকেটটি সংগ্রহ করেছেন এ বছর সাকিব। ৫২ ম্যাচে ৭৬ উইকেট পেয়ে এ তালিকায় সবার ওপরে অবস্থান করছেন তিনি। তার পেছনে রয়েছেন অভিজ্ঞ স্পিনার আব্দুর রাজ্জাক। তিনি ৫২ ম্যাচ খেলে সংগ্রহ করেছেন ৭৫ উইকেট। বছরের শেষের দিকে ওয়ানডে ক্রিকেটের নতুন র্যাঙ্কিং প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)। আর তাতে এক ধাপ উন্নতি হয়েছে বাংলাদেশের তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের। টেস্ট ও টোয়েন্টি২০ ক্রিকেটের অলরাউন্ডারদের তালিকায় আগে থেকেই সাকিব এক নম্বর স্থানটিতেই রয়েছেন; ২১ ডিসেম্বর ঘোষিত ওয়ানডে অলরাউন্ডারদের র্যাঙ্কিং তালিকায় দ্বিতীয়স্থানে উঠে এসেছেন তিনি।
এ ছাড়া ব্যাট হাতে সেঞ্চুরি, বল হাতে ৪ উইকেট; বিস্ময়কর এই কীর্তি দিয়ে ওয়ানডে ইতিহাসে মাত্র ১২ জন খেলোয়াড়ের এক জন হয়ে গেছেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানেডে সিরিজে। সুযোগ ছিল শেষ দুই ওভারের মধ্যে জিম্বাবুয়ের শেষ ব্যাটসম্যানকে নিজেই আউট করে পৃথিবীর মাত্র তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে সেঞ্চুরি ও ৫ উইকেটের মালিক হওয়া। তা না করলেও যা করেছেন, তাই বা কে কবে কল্পনা করেছে! জ্যাক ক্যালিস, স্টিভ ওয়াহ ও সনাথ জয়সুরিয়ার পর মাত্র চতুর্থ ক্রিকেটার হিসেবে ঘরের মাটিতে ২ হাজার রান এবং ১০০ উইকেটের ডাবলস স্পর্শ করেছেন। এ জন্য ঘরের মাটিতে মাত্র ৭১টা ম্যাচ খেলেছেন তিনি। শুধু বোলার হিসেবে নিজের মাটিতে ১০০ উইকেট নিতে অনেক কিংবদন্তীরও এর চেয়ে বেশি ম্যাচ খেলতে হয়েছে।
মুমিনুলের কৃর্তি : চলতি বছর ক্যারিয়ায়ের ১২তম টেস্টে মুমিনুল হক পেয়েছেন ৪র্থ সেঞ্চুরি। যা তাকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। টেস্টে কমপক্ষে ২০ ইনিংস খেলা ক্রিকেটারদের মধ্যে, ব্যাটিং গড়ে মুমিনুল পেছনে ফেলেছেন টেন্ডুলকার, লারা, ক্যালিস ও সাঙ্গাকারাদের। ওপরে আছেন কেবল কিংবদন্তী স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। সেই সঙ্গে টানা ৯ টেস্টে পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস খেলা প্রথম ও একমাত্র বাংলাদেশী ক্রিকেটারও এখন মুমিনুল হক। ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজে করেছিলেন ৩ সেঞ্চুরি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম ২ টেস্টে হাফসেঞ্চুরি পেলেও, সেঞ্চুরি পাচ্ছিলেন না। শেষ টেস্টে সেঞ্চুরি পেয়েছেন চট্টগ্রামের মাঠিতে। চট্টগ্রামে ৩ টেস্ট খেলে করলেন ৩ সেঞ্চুরি। আর এই সেঞ্চুরি উৎসর্গ করেছেন ছোট বোনকে। ১২ টেস্টের ক্যারিয়ারে এরই মধ্যে চার সেঞ্চুরি আর ৭ হাফসেঞ্চুরি মুমিনুলের। টানা ৯ টেস্টে খেলেছেন পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস। যা তাকে নিয়ে গেছে হেইডেন, ক্যালিস ও সাঙ্গাকারাদের পাশে। শুধু তাই না, এই সেঞ্চুরির পর মুমিনুলের ব্যাটিং গড় এখন ৬৩.০৫।
তিনি পেছনে ফেলেছেন সাঙ্গাকারা, ক্যালিস, টেন্ডুলকার, লারাকে।
বছরের সেরা প্রাপ্তি (৮-০) : বছরের শেষে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৩ ম্যাচের টেস্ট ও ৫ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের সবকটি ম্যাচেই জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। বছরের শুরু থেকে টানা হারের বৃত্তেই ছিল লাল-সবুজরা। জিম্বাবুয়েকে পেয়ে হারের বৃত্ত ভেঙ্গে সেখানে সাফল্য গাঁথা রচনা করেছেন মুশফিক-মাশরাফিরা। ঢাকায় প্রথম টেস্ট ৩ উইকেট জয় পেয়েছে মুশফিকরা। খুলনার আবু নাসের স্টেডিয়ামে ১৬২ রানের বড় ব্যবধানে জয়ী হয়ে সিরিজ নিশ্চিত করেছে স্বাগতিক বাংলাদেশ। সিরিজের শেষ টেস্ট ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়েছে চট্টগ্রাম জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে। ওই ম্যাচে ১৮৬ রানের জয় তুলে নিয়ে টেস্ট সিরিজে জিম্বাবুয়েকে হোয়াইটওয়াশ করেছে বাংলাদেশ। টেস্ট সিরিজ হোয়াইটওয়াশ করার পর ওয়ানডে সিরিজেও একই ধারা অব্যহত রেখেছেন সাকিব-মুশফিকরা। চট্টগ্রামের পয়মন্ত ভেন্যুতে ২টি একদিনের ম্যাচে ৮৭ ও ৬৮ রানে জয় লাভ করেছে মাশরাফিরা। ঢাকায় তৃতীয় একদিনের ম্যাচে ১২৪ রানের জয় পেয়েছে স্বাগতিকরা। চতুর্থ ও শেষ একদিনের ম্যাচে ২১ রান ও ৫ উইকেটের জয় নিয়ে ওয়ানডে সিরিজও হোয়াইটওয়াশ করার আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছে বাংলাদেশ। পুরস্কার মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বংয় উপস্থিত থেকে ক্রিকেটারদের পুরস্কৃত করেছেন। আবেগে-আপ্লুত ক্রিকেটবান্ধব প্রধানমন্ত্রী ক্রিকেটারদের নিয়ে তুলেছেন ছবিও।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক শততম জয় : শততম ম্যাচে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। চট্টগ্রাম জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৪২০তম ম্যাচ খেলতে নেমে শততম জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছে ১৯৮৬ এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে মোরাতুয়ায়। নিজেদের প্রথম জয় এসেছে ২৩তম ম্যাচে; ১৯৯৮ সালের ১৭ মে হায়দরাবাদে কেনিয়ার বিপক্ষে। ১০০তম আন্তর্জাতিক জয় পেতে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলতে হয়েছে জিম্বাবুয়ের ৪৪৪টি। তার পরেই অবস্থান বাংলাদেশের। অধিনায়ক হিসেবে হাবিবুল বাশার ৮৭ ম্যাচে নেতৃত্বে দিয়ে জয় পেয়েছেন ৩০ ম্যাচে। সাকিব আল হাসান ৬০ ম্যাচে জয় ২৩টি, মুশফিকুর রহিম ৭৯ ম্যাচে ২৩, মোহাম্মদ আশরাফুল ৬২ ম্যাচে ১০, মাশরাফি বিন মুর্তজা ১৫ ম্যাচে ৯, খালেদ মাসুদ ৪২ ম্যাচে ৪, আমিনুল ইসলাম ১৬ মাচে ২, শাহরিয়ার নাফীস ১ ম্যাচে ১, আকরাম খান ১৫ ম্যাচে ১ জয় তুলে নিয়েছেন। তবে খালেদ মাহমুদ ২৪, নাঈমুর রহমান ১১, গাজী আশরাফ হোসেন ৭, মিনহাজুল আবেদীন ও রাজিন সালেহ ২টি করে ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে জয় পাননি। উল্লেখ্য, ১০০ তম ম্যাচ জিততে সবচেয়ে কম সময় লেগেছে অস্ট্রেলিয়ার। মাত্র ১৯৯ ম্যাচে তারা ১০০ তম আন্তার্জাতিক জয় পায়। এছাড়া ইংল্যান্ড ২৪১, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২৫৬, দক্ষিণ আফ্রিকা ২৯৬, পাকিস্তান ৩০১, শ্রীলঙ্কা ৩২৭, নিউজিল্যান্ড ৩৭৫, ভারত ৩৮৯।
তাইজুলের হ্যাটট্রিক রেকর্ড : জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পঞ্চম ও শেষ একদিনের ম্যাচে নিজের অভিষেক ম্যাচেই হ্যাটট্রিক করে বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন বাংলাদেশ দলের তরুণ স্পিনার তাইজুল। অভিষেক ম্যাচেই হ্যাটট্রিক করার রেকর্ড এর আগে কারোরই নেই। ১ ডিসেম্বর মিরপুর শের-ই-বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে সফরকারী জিম্বাবুয়ে দলের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচে ১১৬তম ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডে অভিষেক হয়েছে নাটোরের ছেলে তাইজুলের। ম্যাচের ১১তম ওভারে বল হাতে নিয়েছেন ২২ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার। প্রথম স্পেলে উইকেট না পেলেও দ্বিতীয় স্পেলের প্রথম ওভারের প্রথম ও ৬ নম্বর বলে উইকেট তুলে নিয়েছেন। এর পরের ওভারের প্রথম দুই বলে ২টি উইকেট তুলে নিয়ে হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেছেন তাইজুল। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের চতুর্থ ক্রিকেটার হিসেবে আর ওয়ানডে ক্রিকেটে বিশ্বের ৩৬তম হ্যাটট্রিক শিকারি হয়েছেন তাইজুল। অভিষেক ম্যাচে ৭ ওভার বল করে ২ মেডেনসহ মাত্র ১১ রানের বিনিময়ে ৪টি উইকেট নিয়ে দক্ষতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন।
হিউজকে উৎসর্গ : ২৫ নভেম্বর সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে শেফিল্ড শিল্ডে (১ম শ্রেণির ম্যাচ) নিউসাউথ ওয়েলস ও সাউথ অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচে পেসার সিন অ্যাবটের শর্ট বলে হুক করতে গিয়ে মাথায় বলের আঘাত পেয়েছেন হিউজ। ৪৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ২৭ নভেম্বর সিডনির সেন্ট ভিনসেন্টস হাসপাতালে মারা গিয়েছেন এই ব্যাটসম্যান। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ২৬টি টেস্ট ও ২৫টি ওয়ানডে খেলেছিলেন ২৫ বছর বয়সী হিউজ। তার মৃত্যুতে ক্রিকেট বিশ্বের শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তাকে স্মরণ করতেই ২৮ নভেম্বর মিরপুরের শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে ৪র্থ ওয়ানডে শুরুর আগে বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটার, আম্পায়ার ও সমর্থকরা ১ মিনিট নীরবতা পালন করেছেন। ক্রিকেটাররা খেলতে নামেন কাল আর্মব্যান্ড পড়ে। ম্যাচ শেষে দলের মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ বলেছেন, আমাদের একজন ক্রিকেটার, অস্ট্রেলিয়ার ফিল হিউজ মারা গেছেন দুঃখজনকভাবে। আজকের(২৮ নভেম্বর) এই ম্যাচ, এই জয় আমরা উৎসর্গ করছি হিউজকে।’ হিউজকে শ্রদ্ধা জানাতে ম্যাচ শেষে বাংলাদেশ দলের ড্রেসিং রুমের সামনে ১১টি ব্যাট দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। ব্যাটগুলোর ওপরে রাখা ছিল খেলোয়াড়দের টুপি।