পাঁচ বছরের পরিসংখ্যান- রেল দুর্ঘটনায় ২০১৩-১৪ সালে হতাহত সবচেয়ে বেশি
গত পাঁচ বছরে দেশে মোট এক হাজার ৯৩টি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ১৫০ জন নিহত ও ৩৮৬ জন আহত হয়েছেন। রেল দুর্ঘটনায় গত পাঁচ বছরে মোট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ১৬ কোটি ৫৫ লাখ ৪৮ হাজার ৮৬৪ টাকা।
রেলওয়ের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৩-১৪ সালে ২০৩টি রেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪৩ জন এবং আহত হয়েছেন ৩৮৬ জন। ২০১২-১৩ সালে সংঘটিত ১৭৬টি রেল দুর্ঘটনায় ২৮ জন নিহত ও ৫৫ জন আহত হন। ২০১১-১২ সালে ১৮২টি রেল দুর্ঘটনায় ২১ জন নিহত ও ৪১ জন আহত হন। ২০১০-১১ সালে ২২৪টি রেল দুর্ঘটনায় ৩৬ জন নিহত ও ১১৪ জন আহত হন। ২০০৯-১০ সালে ৩০৮টি রেল দুর্ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হন ২২ জন ও আহত হন ৩৬ জন।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রেল দুর্ঘটনার সংখ্যা ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত কম থাকলেও ২০১৩-১৪ সালে তা বেড়ে যায় এবং হতাহতের সংখ্যাও পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
সর্বশেষ ২৯ ডিসেম্বর হওয়া কমলাপুরে ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোর (আইসিডি) কার্গো টার্মিনালে ট্রেন ও কাভার্ডভ্যানের সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ছয় জন নিহত ও ২০ জনেরও বেশি যাত্রী আহত হয়েছেন।
রাজধানীর কমলাপুরের সোমবার ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোর (আইসিডি) কার্গো টার্মিনালে ট্রেন ও কাভার্ডভ্যানের মধ্যে সংঘর্ষে নিহতদের একজন নাঈম শিকদার (১৬)।
নাঈমের বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জের খোদাবক্স গ্রামে। তার বাবা ইউনূস আলী শিকদার।
খোদাবক্স কাঠি নেসারিয়া মাদ্রাসার ৯ম শ্রেণীর ছাত্র নাঈম ১০ দিন আগে ছুটিতে ঢাকায় তিন খালার বাড়ি বেড়াতে আসেন।
নাঈমের খালাত ভাই মাসুদ রানা দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে নাঈম সবার বড়। কিছুদিন আগে সে গিয়েছিল নারায়ণগঞ্জে অন্য এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সোমবার ট্রেনে করে ঢাকায় ফেরার পথে ঘটনাস্থলেই সে মারা যায়।’
খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মুগদা থেকে খালা মাজেদা বেগম, মিরপুর-১০ থেকে খালা রিহানা বেগম ও যাত্রাবাড়ি থেকে মিনারা বেগম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) ছুটে আসেন।
নাঈমের খালা মাজেদা বেগম বলেন, ‘ওর মাকে এখন কী জবাব দেব? ঢাকায় এসে সে লাশ হয়ে গেল। তাকে আমরা ঠিকমতো দেখে রাখতে পারলাম না।’
নারায়ণগঞ্জের শিবু মার্কেটে লেপ-তোষকের দোকানে কাজ করতেন ইসমাইল হোসেন (৩৫)। ট্রেন ও কাভার্ডভ্যানের মধ্যে সংঘর্ষের পর ঢামেকে মারা যান তিনি। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার বাসিন্দা ঈসমাইলের বাবার নাম আব্দুল জলিল।
দুর্ঘটনার পর ইসমাইলের বোন ময়না বেগম ঢামেকে আসেন। তিনি বলেন, ‘স্ত্রী হালিমা আক্তার ও দেড় বছরের একমাত্র ছেলে আরাফাতকে নিয়ে ইসমাইলের সংসার। সে সোমবার ভায়রা বেলাল হোসেনের (৩০) সঙ্গে একটি কাজে ট্রেনে করে ঢাকায় আসছিল। কিন্তু শেষ মূহুর্তে দুর্ঘটনার শিকার হন। বেলাল এ ঘটনায় মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে ঢামেকে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তার অবস্থাও আশঙ্কাজনক।
ইসমাইলের স্ত্রী হালিমা আক্তার বলেন, ‘স্বামী ছাড়া আমি এখন কোথায় যাব? কার কাছে যাব? আমরা তো খুবই গরিব। ইসমাইল তো কিছুই রেখে যায়নি। ছেলে আরাফাতকে কীভাবে করব?’
সাধারণত গাড়ি চালকের অসাবধানতা ও রেলওয়ের পর্যপ্ত জনবল ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উপকরণের অভাব থাকায় এ ধরণের দুর্ঘটনা ঘটছে বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের।
কিন্তু রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক রেলওয়ের অব্যবস্থাপনার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘গাড়ি চালকদের অসতর্কতার কারণেই দুর্ঘটনা ঘটছে।’
ওয়ার্ল্ড ফর বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের মাহরুফ আহমেদ (পরিবহন ও রেল যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ) বলেন, ‘রেল একটি সরকারি গণপরিবহণ ব্যবস্থা হলেও এটি এখনও পুরনো নিয়মে চলছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটলেও রেলের লেভেল ক্রসিংগুলো এখন ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে চলছে। এ ছাড়া দায়িত্বরত গেটম্যানদের দায়িত্বে অবহেলার কারণেও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। পাশাপাশি অন্যান্য পরিবহনের চালক এবং যাত্রীদের মধ্যে অধৈর্য কাজ করে। অধিকাংশ দুর্ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সিগন্যাল না মেনে দ্রুত ক্রসিংয়ের চেষ্টার কারণেই এমনটি ঘটছে।’
মাহরুফ আহমেদ বলেন, ‘এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধ করতে পরিবহনের ড্রাইভারদের পাশাপাশি সাধারণ যাত্রীদেরও সচেতন হতে হবে। একটি ট্রেন পাসিংয়ের সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করলে কারোই তেমন ক্ষতি হবে না। যাত্রীরা যদি ড্রাইভারকে ঝূঁকি নিয়ে ক্রসিংয়ে বাধা দেন তাহলে এ ধরনের দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে যাবে।’