‘পানি’ আমদানি করে ফাঁসলেন প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসকের ভাই!
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. প্রাণ গোপাল দত্তের ভাই স্বপন চন্দ্র দত্ত ও তার প্রতিষ্ঠান মেসার্স আপন ইমপোর্ট সেন্টারের বিরুদ্ধে ১ হাজার ৮ মেট্রিক টন ফরমালিনের রাসায়নিক দ্রব্য ‘প্যারাফরমালডিহাইড’-এর পরিবর্তে পানি আমদানির অভিযোগ উঠেছে। যার বাজারমূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসকের ভাই হওয়ায় বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ৫ম বৈঠকে এই দুর্নীতি-অনিয়ম প্রসঙ্গে আলোচনা হয় এবং এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আজ মঙ্গলবার কমিটির ৬ষ্ঠ বৈঠকে বিষয়টি তোলা হলেও তেমন গুরুত্ব পায়নি বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। এতে সভাপতিত্ব করেন কমিটির সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী।
সূত্র জানায়, শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ জামালপুরে অবস্থিত সার কারখানা যমুনা ফার্টিলাইজার মেসার্স আপন ইমপোর্ট সেন্টারের মাধ্যমে প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের ১ হাজার ৮ মেট্রিক টন প্যারাফরমালডিহাইড আমদানি করে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি কেমিক্যাল আমদানি না করে কেমিক্যালের পরিবর্তে ১০০ শতাংশ পানি আমদানি করে আনে। কেমিক্যালের মূল্য বাবদ প্রতিষ্ঠানটিকে এক চতুর্থাংশ মূল্য পরিশোধও করা হয়েছিল। মেসার্স আপন ইমপোর্ট সেন্টারের স্বত্বাধিকারী হলেন স্বপন চন্দ্র দত্ত। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. প্রাণ গোপাল দত্তের ভাই। এ কারণে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাও চলছে বলে সূত্রটি জানিয়েছে। দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা না নেয়ায় কমিটির ৬ষ্ঠ বৈঠকে সদস্যদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এ বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী প্রিয়.কম-কে বলেন, কমিটির ৫ম বৈঠকে এই দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে। এজন্য তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি সাব-কমিটি গঠন করে তাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এই অনিয়মের সাথে যারাই জড়িত থাকুক না কেন তাদের বিরুদ্ধে সংসদীয় কমিটিতে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সুপারিশ করা হয়েছে।
সংসদীয় কমিটির বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) একজন কর্মকর্তা বরখাস্ত ও দু’জন কর্মকর্তা পিএলআর-এ যাওয়ায় তাদের চাকুরিগত চূড়ান্ত পাওনাদি স্থগিত করা হয়েছে।
সূত্রে জানা গেছে, অনিয়মের বিষয়ে বিসিসিআই-এর গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে সরবারহকারী ও পিএসআই এজেন্টের পারস্পরিক যোগসাজসে এমন অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছে বলেও উল্লেখ করা হয়।
সংসদীয় কমিটির সদস্য আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরী প্রিয়.কম-কে বলেন, আমি গত বৈঠকে এই অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম। আমি বলেছি, বিসিআইসি’র কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণেই এই অনিয়ম হয়েছে।
এ ঘটনায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়ী করে ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য সরবারহকারী ও পিএসআই এজেন্টের বিরুদ্ধে ঢাকার ৩য় যুগ্ম জজ আদালতে মানি স্যুট মামলা দায়ের করা হয়েছে। যা বর্তমানে আইনি প্রক্রিয়ায় রয়েছে বলেও সংসদীয় কমিটির বৈঠকে উঠে এসেছে।
মামলায় যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইখলাস উদ্দিন বাদী হয়ে মেসার্স আপন ইমপোর্ট সেন্টারের স্বত্বাধিকারী স্বপন চন্দ্র দত্ত, চাইনিজ কোম্পানি এমএস ভিকটোরিয়া লিমিটেড ও নিরক্ষক কোম্পানি এমএস কন্টিনেন্টাল ইন্সপেকশনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ৫ম বৈঠকে সাংসদ আবুল কামাল মো আহসানুল হক চৌধুরী বলেন, যমুনা ফার্টিলাইজার চীন থেকে আনদানিকৃত ১০০৮ মেট্রিকটন প্যারাফরমালডিহাইড এর পরিবর্তে ১০০ শতাংশ পানি আমদানির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ সময় বিসিআইসি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইকবাল জানান, গত ১৭ আগস্ট এই বিষয়ে জামালপুর কোর্টে ফৌজাদারী মামলা করা হয়েছে। তদন্তকালে পিএসআই ও এক্সপোটারদের যোগসাজস ছিল।
এ বিষয়ে কমিটির সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, সিএনএফ এজেন্টের মাধ্যমে আমার কাছে একটি কাগজ এসেছে। এতে বোঝা যাচ্ছে ফ্যাক্টরির ভেতরের কিছু লোক আছে। তাদের কারসাজি আছে।
বৈঠকে বিসিআইসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইকবাল জানান, কন্টিনেন্টাল পিএসআইকে ব্ল্যাকলিস্টে তালিকাভূক্ত করা হয়েছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা কাজ করবে। নতুন পিএসআই কোম্পানি আনার জন্য টেন্ডার আহবান করা হয়েছে। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে এই ঘটনা ঘটেছে।
কমিটির বৈঠকে বিসিআইসি’র সার্বিক দুর্নীতির বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখার জন্য কমিটির সদস্য মো. আব্দুর রাজ্জাককে আহবায়ক করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়েছে। অপর দু’সদস্য হলেন- আবুল কালাম মো আহসানুল হক চৌধুরী এবং বেগম ফাতেমা তুজ্জহুরা। তারা আগামী তিন মাসের মধ্যে এই বিষয়ে প্রতিবেদন উপস্থপন করবেন।
বৈঠকে শাহজালাল ফার্টিলাইজার প্রকল্পের খাত ওয়ারী এর বাস্তব অগ্রগতি এবং সিডিউল অনুযায়ী কি কি কাজ করা হয়েছে এবং সিডিউল মোতাবেক কাজের জন্য কি পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে তার বিস্তারিত প্রতিবেদন কমিটির পরবর্তী বৈঠকে প্রদানের বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।
বৈঠকে বিসিআইসি’র সার্বিক কার্যক্রম এবং বিভিন্ন সমস্যাবলী, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন (বিএসএফআইসি) এবং বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) এর বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্র্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। বিসিআইস‘র স্থায়ী ও এডহক ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া একই পদ্ধতিতে করার বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। বিসিআইসির জনবল নিয়োগ সম্পর্কে তদন্তপূর্বক দোষিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।