দশম সংসদের এক বছর: ‘বিরোধী দলের’ উপস্থিতিই বড়
বহুল আলোচিত-সমালোচিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত দশম জাতীয় সংসদ এক বছর পার করতে যাচ্ছে। সংসদের সবগুলো অধিবেশনেই সরকারের সমালোচনায় উপস্থিত ছিল প্রধান ‘বিরোধী দল’ জাতীয় পার্টি। পুরো বছরই দলটি সংসদে উপস্থিত থাকলেও বেশকিছু বিষয়ে ‘গ্রহণযোগ্যতা’ অর্জন করতে পারেনি এই সংসদ।
তার পরেও এই সংসদের অর্জন কম নয়। প্রথমবারের মতো কোনো সংসদ সদস্য বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর নেতৃত্বদানকারী ফোরামের প্রধান নির্বাচিত হওয়া এ সংসদের বড় অর্জন। তবে দেশের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল শুরু থেকেই এ সংসদকে বর্জন করে আসছে। তাদের মতে, এ সংসদ অবৈধ। এদের সকল কার্যক্রমও অবৈধ।
দশম জাতীয় সংসদের প্রাথমিক পথচলা শুরু হয় ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। একটি বৃহৎ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়েই গঠিত হয় দশম সংসদ। বর্তমান সংসদের সদস্য হিসেবে ১২ জানুয়ারি শপথ নেন এমপিরা। এর পর ১৩ জানুয়ারি নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। তবে এ শপথ অনুষ্ঠানও ছিল অনেকটা ‘নাটকীয়’। কেননা প্রথম দফায় সরকার ও বিরোধী দলের অধিকাংশ সদস্য শপথ নিলেও নেননি বর্তমান বিরোধী দলের প্রধান ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। মিডিয়ার চোখ ফাঁকি দিয়ে এক দিন পরে যদিও কঠোর পাহারার মধ্য দিয়ে তিনি শপথ নেন। প্রথম দিকে গুঞ্জন ওঠে, এরশাদের জাতীয় পার্টির অন্য সদস্যরা শপথ নিলেও নেবেন না পার্টির চেয়ারম্যান। এতে সরকার গঠনে এক ধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টি হতে পারে। তবে সবকিছুর অবসান হয় এরশাদের শপথের মধ্য দিয়ে।
২০১৪ সাল ছিল সংসদের ইতিহাসে অনেক কিছুর সাক্ষী : দশম জাতীয় সংসদ ইতিহাসের অনেক কিছুরই সাক্ষী হয়ে থাকবে। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সদস্যদের দিক দিয়ে এটিই প্রথম। এ সংসদে ১৫৪ জন সদস্যই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। এ ছাড়া সর্বোচ্চসংখ্যক স্বতন্ত্র সদস্যও রয়েছেন এ সংসদে।
দশম জাতীয় সংসদে ১৬ জন স্বতন্ত্র সদস্য রয়েছেন। বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি প্রথমবারের মতো নাম লেখায় সংসদে। বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে রওশন এরশাদও প্রথম।
স্বাধীনতাবিরোধীমুক্ত সংসদ : ১৯৭৩ সালের পর এই প্রথম যুদ্ধাপরাধমুক্ত সংসদও এটি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর যে সব সংসদ গঠিত হয়েছে, তাতে প্রায় প্রতিটি সংসদেই যুদ্ধাপরাধীদের অংশগ্রহণ ছিল। দশম সংসদে বিএনপি-জামায়াত অংশ না নেওয়ায় স্বাধীনতাবিরোধীমুক্ত সংসদ গঠিত হয় এবার।
এক দিনও অনুপস্থিত থাকেনি বিরোধী দল : দশম জাতীয় সংসদের এ পর্যন্ত ৪টি অধিবেশন শেষ হয়েছে। এরই মধ্যে ৮৩টি কার্যদিবস শেষ করেছে দশম সংসদ। প্রথম অধিবেশন থেকে প্রতিটি অধিবেশনেই বিরোধী দলের উপস্থিথি ছিল উল্লেখ্যযোগ্য। বিরোধীদলীয় নেতাও প্রায় প্রতিদিনই উপস্থিত ছিলেন সংসদে।
দশম সংসদের অর্জন : নানাদিক থেকে দশম সংসদ নিয়ে নেতিবাচক ধারণা থাকলেও অর্জন কম নয়। সব সমালোচনার জবাব দিয়েছে দশম সংসদের দু’জন সদস্যর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষ দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে। গত ৯ অক্টোবর জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এ্যাসোসিয়েশনের (সিপিএ) চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। এর এক সপ্তাহ পর ১৬ অক্টোবর দশম সংসদের আরেক সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। একসঙ্গে দুটি আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক ফোরামের বর্তমান নেতৃত্ব বাংলাদেশের হাতে। দশম সংসদ নিয়ে সমালোচনা থাকলেও এ দুটি অর্জন সবকিছুকে পেছনে ঠেলে দিয়েছে। সংসদের গ্রহণযোগ্যতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টানা দ্বিতীয়বার ক্ষমতা গ্রহণও এ বছরের বড় অর্জন। এর মধ্য দিয়ে কোনো দল টানা দু’বার ক্ষমতায় আসীন হল।
৪ জন সিটিং এমপির পরলোকগমন ১ জনের কারাবাস : দশম জাতীয় সংসদের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত চারজন সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। আরেকজন সদস্য নিজ বক্তব্যে সমালোচিত হয়ে কারাবাস করছেন। দশম জাতীয় সংসদের সিটিং এমপি হিসেবে যারা পরলোকগমন করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন— টাঙ্গাইলের শওকত মোমেন শাহজাহান, বরিশালের শওকত হোসেন হিরন, নারায়ণগঞ্জের নাসিম ওসমান ও সিরাজগঞ্জের ইসহাক আলী। হজ-তবলীগ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করায় কারাবাস করছেন এক সময়কার প্রভাবশালী মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। এটিও ২০১৪ সালের আলোচিত ঘটনা।
২০১৪ সালের ৪ অধিবেশন : চলতি বছর দশম জাতীয় সংসদের চারটি অধিবেশন শেষ হয়েছে। প্রথম অধিবেশন শুরু হয় ২৯ জানুয়ারি, শেষ হয় ১০ এপ্রিল। প্রথম অধিবেশনের মোট কার্যদিবস ছিল ৩৬টি। এর পর দ্বিতীয় ও নতুন সরকারের প্রথম বাজেট অধিবেশন শুরু হয় ৩ জুন, যা শেষ হয় ৩ জুলাই। মোট ২৩ কার্যদিবস চলে এ অধিবেশন। তৃতীয় অধিবেশন শুরু হয় ১ সেপ্টেম্বর, শেষ হয় ১৮ সেপ্টেম্বরভ মোট কার্যদিবস ছিল ১৪ দিন। এ ছাড়া ২০১৪ সালের শেষ অধিবেশন ১৩ নভেম্বর শুরু হয়ে শেষ হয় ৩০ নভেম্বর। মোট কার্যদিবস ছিল মাত্র ১০ দিন।
২০১৪ সালে ১৯ বিল পাস : দশম জাতীয় সংসদের চারটি অধিবেশনের ৮৩ কার্যদিবসে পাস হয়েছে ১৯টি বিল। এর মধ্যে তৃতীয় অধিবেশনের শেষ কার্যদিবসে পাস হয় বহুল আলোচিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল-২০১৪, যে বিল পাসের মাধ্যমে বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা আইন প্রণেতাদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
২০১৪ সাল ছিল বৃহৎ রাজনৈতিক দলের সংসদ বর্জনের বছর : সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হওয়ার পর এই প্রথম দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি সংসদে নেই। ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে দশম সংসদকেই বর্জন করে তারা। শুরু থেকেই বিএনপিসহ তাদের শরিক দলগুলো এ সংসদকে বর্জনের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে। তাই তাদের কাছে ছিল এটি বর্জনের বছর।
এদিকে দশম জাতীয় সংসদ নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা দুটিই রয়েছে।
এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘প্রথমত যে নির্বাচনের মাধ্যমে দশম জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে, সেটা কতটুকু গ্রহণযোগ্য। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী নির্বাচনটি বৈধ হলেও মোট ১৫৪ জন সদস্য বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছে। অর্থাৎ দেশের অর্ধেকের বেশী মানুষ ভোট প্রদান করতে পারেননি। এর পর বাকি যে ১৪৬টি আসনে নির্বাচন হয়েছে তার মধ্যেও দেখা যায়, বেশকিছু কেন্দ্রে কোনো ভোটই পড়েনি। ভোটার উপস্থিতি নিয়েও বির্তক রয়েছে।’
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এটা তো গেল নির্বাচনের বিষয়। এখন আসুন সংসদের কার্যকারিতার বিষয়ে। সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থাহীনতা দেখা যায়, সেখানে একটি দল সরকার ও বিরোধী দলের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করবে, তা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য?’
তিনি বলেন, ‘কিন্তু বাস্তবতা হল, জাতীয় পার্টি কাগজে-কলমে বিরোধী দল। কিন্তু বিএনপিই এখনো বিরোধী দলের ভূমিকায় রয়েছে। এর প্রমাণ মেলে সংসদের চারটি অধিবেশনে। এই অধিবেশনে সরকারি দলের কোনো সদস্যকে দেখিনি বিরোধী দল জাতীয় পার্টির কোনো বিষয়ে সমালোচনা করেছে বা বিরোধী দলের কেউ সরকারের কোনো সিদ্ধান্তে বিরোধিতা করেছে। তবে দুই দিন জাতীয় পার্টি ওয়াকআউট করেছে সত্য; তবে তা অনেকের কাছে লোক দেখানো বলে মনে হয়েছে।’
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘তবে বর্তমান সংসদে ইতিবাচক একটি দিক হল, কাগজে-কলমে হোক আর যাই-ই হোক, জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হিসেবে সংসদে উপস্থিত ছিল। আর তারা অধিকাংশ বিলে বক্তব্য রেখেছে, সংশোধনী এনেছে।’